ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বেজিং ও দিল্লীর মধ্যে নানা বিষয়ে পরস্পরের উদ্বেগ থাকলেও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই সমানতালে সম্পর্ক রাখছে ঢাকা ;###;কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়ার পরও মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি

প্রভাবশালী ৩ পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় ॥ ভারসাম্যের কূটনীতি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২২ এপ্রিল ২০১৭

প্রভাবশালী ৩ পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় ॥ ভারসাম্যের কূটনীতি

তৌহিদুর রহমান ॥ বেজিং, দিল্লী ও মস্কোর সঙ্গে সমানতালে সম্পর্ক বজায় রেখে ভারসাম্যের কূটনীতি রক্ষা করে চলেছে সরকার। বিশ্বের প্রভাবশালী এই তিন পক্ষের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে সম্পর্কের নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বেজিং ও দিল্লীর মধ্যে নানা বিষয়ে পরস্পরের উদ্বেগ থাকলেও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই এই দুই পক্ষের সঙ্গে সমানতালে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে ঢাকা। এদিকে কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়ার পরেও ঢাকা-মস্কো সম্পর্কে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। সূত্র জানায়, চীন এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদার। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ, সমুদ্রসীমা রক্ষায় ঢাকা-বেজিং একযোগে কাজ করছে। বাংলাদেশ ও চীন দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতাও করছে। দুই দেশের মধ্যেই অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক এখন ধীরে ধীরে কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ‘গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার’ বলেও মনে করে চীন। দেশটির ‘এক চীন নীতি’তেও বাংলাদেশ বরাবরই জোরালো সমর্থন দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। গত বছর অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফর করেছেন। শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্যে দিয়ে ঢাকা-বেজিং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বেশ গতি পেয়েছে। বিশেষ করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও বেড়েছে। উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও চীন। ২০১৫ সালে ঢাকা-বেজিং কূটনৈতিক সম্পর্কের চল্লিশ বছর পূর্তিও হয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফর করেছিলেন। দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের সফরে সমঝোতা ও চুক্তির মধ্যে ঢাকা-বেজিং সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও ধীরে ধীরে বেড়েছে। চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জামও কিনে থাকে বাংলাদেশ। দেশটির সঙ্গে অনেক আগেই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি হয়েছিল। সেই প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় চীন থেকে সম্প্রতি দুটি সাবমেরিন ক্রয় করে বাংলাদেশ। তবে এই সাবমেরিন ক্রয় নিয়ে দিল্লীর উদ্বেগ ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের মধ্যে দিল্লীর ওই উদ্বেগ এখন অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। এদিকে ২০১৪ সালে ভারতে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। আওয়ামী লীগ ও বিজেপি সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সমীকরণ কেমন হবে, এটা নিয়ে অনেকের মধ্যেই উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। তবে বিজেপি ক্ষমতায় এলেও ঢাকা-দিল্লীর মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ঢাকা-দিল্লীর ঐতিহাসিক সম্পর্কে আরও গতি পেয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের ৬-৭ জুন ঢাকা সফর করেন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭-১০ এপ্রিল দিল্লী ফিরতি সফর করেছেন। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় স্থল সীমান্ত চুক্তিসহ দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লী সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ৩৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এই সফরের মধ্যে দিয়ে ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে ৭২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ভারত সরকার ঋণ দেবে আরও ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ও ভারতের সরকারী ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর ভারত এখন অনেকটাই স্বস্তিতে রয়েছে। তবে এই প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক নিয়ে বেজিংয়ের কোন উদ্বেগ নেই। কেননা বেজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার প্রতিরক্ষা চুক্তি অনেক আগে থেকেই রয়েছে। বেজিং ও দিল্লীর সঙ্গে সমানতালে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার চীন, ভারত ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে যে সম্পর্কের উন্নয়ন করেছে, সেটা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় স্বার্থরক্ষা করেই কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এখানে দুই দেশের মধ্যে তিনি জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। রিয়েল ডিপ্লোমেসি (সত্যিকার কূটনীতি) বলতে যা বোঝায়, প্রধানমন্ত্রী সেটা করতে সক্ষম হয়েছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এদিকে মস্কোর সঙ্গে ঢাকা ও দিল্লীর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন বছর আগে মস্কো সফর করেছেন। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ক্ষমতায় আসার পর মস্কো সফর করেছেন। গত ১০ বছরে প্রতিরক্ষা খাতে ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থের অস্ত্র কিনেছে ভারত। মস্কো থেকে দিল্লীর ধারাবাহিকভাবে অস্ত্র কেনার ইতিহাসও রয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের সময় প্রতিরক্ষা খাতে ঋণ সহযোগিতার আওতায় ভারত বাংলাদেশকে যে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার দেবে, সেখান থেকে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে অস্ত্র ও সরঞ্জাম কিনতে পারবে। এই অর্থ থেকে রাশিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশ মিগ-২৯-সহ অন্যান্য অস্ত্র কিনতে পারবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে কসভোকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য ঢাকার প্রতি মস্কোর চাপ ছিল। কেননা মস্কো মনে করে ওয়াশিংটনের প্রত্যক্ষ মদদে কসোভোর জন্ম হয়েছে। সে কারণে বিভিন্ন সময়ে মস্কোর পক্ষ থেকে ঢাকাকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ যেন কোনভাবেই কসোভোকে স্বীকৃতি না দেয়। অপরদিকে কসভোকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও চাপ ছিল। তবে বাংলাদেশ সম্প্রতি কসোভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য কসোভাকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দোটানায় ছিল। অবশেষে ১১৩টি দেশের স্বীকৃতি দেয়ার পরে বাংলাদেশ কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে ঢাকা-মস্কোর মধ্যে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত ১২-১৬ এপ্রিল মস্কো সফর করেছেন। মস্কো থেকে রবিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ঢাকায় ফিরেছেন। মস্কো সফরকালে সেখানে ১৩ এপ্রিল মাহমুদ আলী রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকও করেছেন। বৈঠকের পর রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ জানিয়েছেন, জাতিসংঘ ও এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মতো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে পারস্পরিক সমন্বয় ও যোগাযোগ বজায় রাখতে ঢাকা-মস্কো সম্মত হয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ঢাকা-মস্কোর মধ্যে অভিন্ন অবস্থান রয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রুশ প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী শেখ হাসিনার এই আমন্ত্রণপত্র রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে হস্তান্তরও করেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী আগস্ট মাসে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফর করবেন। গত বছর জুলাই মাসে মঙ্গোলিয়াতে আসেম শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানে রশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিষয়টিও আলোচিত হয়। এছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরে টেলিকম ও যোগাযোগ ও সংবাদ সংস্থা বাসস ও ইতার তাসের মধ্যে দুটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। রাশিয়া বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে সহযোগিতা দিচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ বরাবরই রাশিয়া থেকে অস্ত্র কিনে থাকে। এখন রাশিয়া থেকে পাঁচটি অত্যাধুনিক এমআই-১৭ হেলিকপ্টার কেনার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এই হেলিকপ্টারগুলো কেনার পর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কাজে লাগানো হবে।
×