ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

গন্তব্য নয়, দূরের টিকেট কাটতে বাধ্য হচ্ছেন ট্রেনযাত্রীরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭

গন্তব্য নয়, দূরের টিকেট কাটতে বাধ্য হচ্ছেন ট্রেনযাত্রীরা

আজাদ সুলায়মান ॥ ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায় যাত্রী দাঁড়ানো অবৈধ। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ এমন অপরাধ প্রতিদিন ঘটছে প্রতিটি ট্রেনে। এ নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে প্রতিদিনই ঘটছে মারামারি ও সংঘর্ষ। আবার দাঁড়ানো যাত্রীর কাছ থেকে চড়া মূল্য নেয়া হলেও তাদের দেয়া হচ্ছে না টিকেট বা প্রাপ্তি রশিদ। এটাও অপরাধ, দুর্নীতি। অভিযোগের শেষ এখানেই নয়। যাত্রীদের বাধ্য করা হয় নিজ গন্তব্যের বাইরে দূরের টিকেট কাটতে। আর সময়সূচী? সেটা আরও লজ্জার। সকাল সাতটার ট্রেন যায় আটটায়। কেন এমন হচ্ছে তার সঠিক ব্যাখ্যা কারও কাছে নেই। বৃহস্পতিবার সকালে এগারসিন্দুু প্রভাতীযোগে বিমানবন্দর রেল স্টেশন থেকে বাজিতপুর যাওয়ার সময় এমনই সব অনিয়ম চোখে পড়ে। টিকেট কাটা থেকে শুরু করে ট্রেনে চড়ে গন্তব্যে নামা পর্যন্ত যা চোখে পড়েছে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে বৃহস্পতিবার সকাল সাতটার এগারসিন্দু প্রভাতীযোগে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর যাবার জন্য প্রথম শ্রেণীর টিকেট কাটতে পর পর তিনদিন গিয়ে ধর্ণা দিতে হয়। বিমানবন্দর রেলস্টেশনে টিকেট কাউন্টার থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয়- টিকেট না থাকলে করার কিছুই নেই। অন্য এলাকার টিকেট কেটেই বাজিতপুর যেতে হবে। কোথাকার টিকেট? কাউন্টারের জবাব, ২০০ টাকায় কিশোরগঞ্জের টিকেট কেটে যেতে হবে বাজিতপুর- যার ভাড়া ১২৫ টাকা। পর পর তিন দিন কাউন্টারে গিয়েও বিমানবন্দর থেকে বাজিতপুর স্টেশনের প্রথম শ্রেণীর কোন টিকেট পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়েই কিশোরগঞ্জের টিকেট কেটে বাজিতপুর যেতে হয়। এতে খেসারত দিতে হয়েছে ৭৫ টাকা। অর্থাৎ ১২৫ টাকার টিকেট ২০০ টাকায় কাটতে বাধ্য করা হয় স্টেশনেই। ডিএবি-০৩১৮৪৪৭১ নম্বরের গ কামরায় প্রথম শ্রেণীর টিকেট হাতে নিয়ে দেখা যায়, তাতে ট্রেন ছাড়ার সময়সূচী লেখা, সকাল সোয়া সাতটা। এটাও অমান্য করেছে রেল বিভাগ। সোয়া সাতটার ট্রেন বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায় আটটা বাজার ছয় মিনিট আগে। ওই কামরায় উঠতেই ঘটে বিপত্তি। দরজার মুখে এমনভাবে আবালবৃদ্ধবনিতা জটলা পাকিয়ে দাঁড়ানো, ওঠাই মুস্কিল। ঠেলাধাক্কায় ওঠার পর দেখা যায়Ñওই আসনে অন্য একজন বসা। তাকে টিকেট দেখিয়ে বসতে চাইলে তিনি বিরক্তচিত্তে আসন ছাড়েন। তিনি ঘাড়ের ওপরই দাঁড়িয়ে থাকেন উপরের হাতল ধরে। সকাল সোয়া সাতটার ট্রেন আটটায় ছাড়ার পর দেখা যায়, ভেতরের অবস্থা আরও তথৈবচ। প্রথম শ্রেণীর কামরায় গাদাগাদি করে দাঁড়ানো যাত্রী। তাদের ঠেলেই আসন গ্রহণের পর ঘটে যায় হাতাহাতির ঘটনা। চেয়ারে বসা এক ভদ্রলোকের ঘাড়ের ওপর পান খেয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন এক মহিলা। ওই ভদ্রলোক কিছু বলতেই মহিলা খেকিয়ে ওঠেন, “এত নবাবী দেখাচ্ছেন, তাহলে কেবিনে গেলেন না ক্যান? এতে ভদ্রলোকও ক্ষিপ্ত হয়ে মহিলার টিকেট দেখতে চান। এ নিয়ে চলে তর্কাতর্কি যা খানিক পরেই রূপ নেয় গালিগালাজে। বিরক্ত হয়ে অন্য যাত্রীরাও ভদ্রলোকের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে মহিলাকে শাসাতে থাকেন। তখন দাঁড়িয়ে থাকা জনাদশেক যাত্রী এসে মহিলার পক্ষ নেয়। তারাও যু্ক্িত দেখান এই বলে-টিকেট না কাটলেও তো পুরো এক শ’ টাকা দিয়েই তো যেতে হচ্ছে। দুপক্ষের তুমুল বিবাদ যখন হাতাহাতির উপক্রম তখন নিজ আসন থেকে উঠে দাঁড়ান বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব) আখতারুজ্জামান রঞ্জন। ঢাকা থেকে নিজ বাড়ি গচিহাটার এই যাত্রী অবৈধ যাত্রীদের সতর্ক করেন এবং প্রথম শ্রেণীর কামরার পবিত্রতা ও যাত্রী অধিকার বজায় রাখার অনুরোধ জানান। এ সময় তিনি ডেকে আনেন রেল নিরাপত্তাকর্মী ও অন্যান্য কর্মচারীকে। তাদের কাছে জানতে চানÑ টিকেট ছাড়া কিভাবে এত যাত্রী প্রথম শ্রেণীর কামরায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তখনই বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল। দাঁড়ানো যাত্রীদের একজন মাসুম জানালেন, তিনি কমলাপুর থেকেই ভৈরব পর্যন্ত যাবার জন্য ট্রেনের এক নিরাপত্তাকর্মীকে পরিশোধ করেন এক শ’ টাকা। তার মতো সব দাঁড়ানো যাত্রীরই একই অভিযোগ। মাসুম এ প্রতিনিধির কাছে এভাবে টিকেটের পরিবর্তে যাত্রী বাণিজ্যের অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের সবাইকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়া হয় পাশের শোভন কামরায়। মান্নান নামে এক যাত্রীর অভিযোগ, এমন চিত্র শুধু এই কক্ষেরই নয়। ট্রেনের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের প্রতিটি কক্ষেই টিকেট ছাড়া যাত্রী রয়েছে। এদের এক পয়সাও জমা হয় না সরকারের রাজস্ব খাতে। বিমানবন্দর ও কমলাপুর রেলস্টেশনের একটি সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্ত প্রতিদিন প্রতিটি ট্রেন থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। কেউ প্রতিবাদ করা বা দেখার নেই। মাঝে মাঝে রেলের ভেতর কেউ প্রতিবাদ করলেও তার ওপর চড়াও হয় সংঘবদ্ধ এই দুর্বৃত্তরা। বছর তিনেক আগে শামীম নামের এক যাত্রী প্রতিবাদ করায় তাকে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া হয়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের এক কর্মকর্তা জানান, কিছু অপরাধী মাঝে মাঝে স্টেশনে উৎপাত করে। তারা টিকেট নিয়ে কামরার ভেতরেও যাত্রীদের সঙ্গে বিরোধে জড়ায়। এটা দেখার দায়িত্ব রেল পুলিশের। বাজিতপুর যেতে হলে কিশোরগঞ্জের টিকেট কিনতে বাধ্য করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা মাঝে মাঝে হয়। কারণ প্রথম শ্রেণীর টিকেটের খুব চাহিদা। অগ্রিম না কাটলে স্ট্যান্ডবাই পাওয়া যায় না। সেজন্য অনেকেই কাছের গন্তব্যে যেতে একটু বেশি টাকা দিয়ে দূরের টিকেট কাটে। এ সম্পর্কে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন ফারুক বলেন, রেল পুলিশের দায়িত্ব বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। একেক ট্রেনে একেক থানার পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। ট্রেনের অভ্যন্তরে যাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশ ও ট্রেনগার্ডের (টিজি)। বিশেষ কোন অভিযোগ পেলে রেলপুলিশ সেটার তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়।
×