ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

তুরাগ তীরের অবৈধ স্থাপনা আছে কিনা খতিয়ে দেখার নির্দেশ

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার আপীল শুনানি ৮ ফেব্রুয়ারি

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার আপীল শুনানি ৮ ফেব্রুয়ারি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে করা আপীল শুনানির জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করেছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। ওই দিন আপীল বিভাগের আদেশ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই আপীল শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে তুরাগ নদীর উভয় তীরের অবৈধ স্থাপনা এখনও আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। গাজীপুরের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে এ তদন্ত করতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার আপীল বিভাগ ও হাইকোর্টের বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের আপীল শুনানি ৮ ফেব্রুয়ারি । রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন শুনানিতে বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপীল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এই আদেশ দেয়। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রিটকারীর পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। এর আগে ৪ জানুয়ারি হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। বৃহস্পতিবার সকালে বিষয়টি শুনানির জন্য আসলে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম চার সপ্তাহের সময় চেয়ে আবেদন করেন। তিনি বলেন, এটা অনেক বড় রায়Ñপ্রস্তুতির সময় প্রয়োজন। এর পরই আদালত ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করে দেয়। আদেশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, বিচারপতিদের একটা ধারণা হলো পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমেই কাউকে অপসারণ করে ফেলবে। আসল ব্যাপারটা হলো, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ এলে নানারকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিদ্ধান্তটা গৃহীত হবে। এবং তদন্ত হবে। তদন্তগুলো করবেন নির্ধারিত কিছু ব্যক্তি আইন দ্বারা যাদেরকে ক্ষমতা প্রদান করা হবে। এই সমস্ত ব্যক্তি যদি দেখেন কোন বিচারপতির বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগটা প্রমাণিত তখনই তারা তাদের অভিমতটা পার্লামেন্টে পাঠাবেন। তখন পার্লামেন্ট এটা দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হলে তিনি অপসারিত হবেন। কাজেই পার্লামেন্টে নিয়েই একজন বিচারপতিকে যে অপসারণ করা সবার মনেই একটা ধারণা এটা ঠিক নয়। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট আইন হবে এবং আইনের বিলও সুপ্রীমকোর্টে পাঠানো হয়েছিল উনারা তখন বলেছেন যেহেতু বিচারাধীন মামলা সেহেতু উনারা এটা বিবেচনা করেননি। সেই আইনটা বিবেচনা করার স্কোপ সব সময়ই আছে। এদিকে শুরুতেই শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্টের রায় অনেক বড়। প্রস্তুতির জন্য সময় প্রয়োজন। এজন্য চার সপ্তাহ সময় চেয়ে আবেদন দিয়েছি। আদালত বলে, এটা নিয়ে দ্রুত শুনানির প্রয়োজন আছে কিনা? এ সময় আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, অবশ্যই জরুরী। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন , দুটো অঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ করার জন্য হাইকোর্টেল রায়ে অনেক নির্মম মন্তব্য করা হয়েছে। আদালত জানায়, আমরা বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি করতে চাই। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা কিন্তু ক্রান্তিকাল। আপনারা নিজেদের বিচার নিজেরাই করতে যাচ্ছেন। আদালত জানায়, আপনি একপেশে মন্তব্য করবেন না। আমাদের একটা রাস্তায় আসতে হবে। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, দুঃখিত। হয়ত আমি আদালতকে বুঝিয়ে বলতে পারছি না। আদালত বলে, পুরো বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার মধ্যে যাচ্ছে। নি¤œ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কোন শৃঙ্খলা বিধিমালা নেই। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রেও কোন আইন নেই। একটা শূন্যতা চলছে। শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে একজন প্রধান বিচারপতি হিসেবে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই সব পেশারই একটি শৃঙ্খলাবিধি থাকা দরকার। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, নি¤œ আদালতের একজন বিচারক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ দিয়ে বিচার বিভাগে কর্মরত থাকবেন, এটা আশ্চর্যজনক। আদালত বলে, ভারত সরকার সেদেশে বিচারক নিয়োগে একটা আইন করেছিল। ভারতীয় সুপ্রীমকোর্ট সে আইন বাতিল করে দিয়েছে। আমরাও ৫ম, ৮ম ও ১৩তম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হলো সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ। এটাকে পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু আপনারা সেটিই করেছেন। বিচার বিভাগে স্বাধীনতা শুধু কোন একক বিচারকের বিষয় নয়। এটা পুরো বিচার বিভাগের বিষয়। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ১৬তম সংশোধনীর রায়ে হাইকোর্ট সংসদ সদস্যদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছে তা দুর্ভাগ্যজনক। আদালত বলে, আমরা বিষয়টি দেখব। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রিট আবদেনকারীপক্ষ তাড়াহুড়ো করে মামলা শুনানি করতে চায়। আদালত বলে, উনাদের দোষ দেবেন না। উচ্চ ও নি¤œ আদালতে মামলা জট রয়েছে। যে যত বড় কর্মকর্তাই হোক, একটা শৃঙ্খলাবিধি থাকা দরকার। এ ধরনের মামলা যত তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করা যায় ততই রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর। আমরা কোন মামলাই ফেলে রাখি না। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যখন সংবিধান সংশোধন করা হয় তখনই বিচারক অপসারণের জন্য একটা আইন থাকবে বলে বলা হয়। ওই আইন ভাল না খারাপ তার বিচার হবে এখানে। আর ওই আইনের স্টেকহোল্ডার হলেন আপনারা বিচারকরা। এজন্য এ আইনের ওপর আপনাদের মতামত দেয়া দরকার ছিল। আদালত বলে, এ আইন আমরা দেখব না। যখন হাইকোর্টে রিট মামলা বিচারাধীন ছিল তখনই আপনারা তাড়াহুড়ো করে ওই আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন। বিচারাধীন থাকাবস্থায় আপনারা যে আইনের খসড়া করেছেন তা আমরা গ্রহণ করব না। এটাই আমাদের বার্তা। সরকারকে বিষয়টি অবহিত করবেন। বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের যোগাযোগ (সমন্বয়) যিনি করেন তিনি এখানে এসে এক ধরনের কথা বলেন। আবার মন্ত্রিপরিষদে ও সংসদে ভিন্ন কথা বলেন। এর আগে ২৮ নবেম্বর সংসদ কর্তৃক বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ১৬তম সংশোধনীর অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায় চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার জন্য আপীল বিভাগে আবেদন করেন রিটকারী আইনজীবী। ওই দিন এই তথ্য নিশ্চিত করেন রিটকারী আইনজীবী এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। গত বছরের ৫ মে সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে দুই বিচারপতি ১৬তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও এক বিচারপতি ওই সংশোধনী বহাল রেখে রিট আবেদন খারিজ করেন। এর পর গত বছরের ১১ আগস্ট উচ্চ আদালতে বিচারক অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় প্রকাশিত হয়। ঐদিন সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে একশ’ ৬৫ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এই রায় দেয়। রায়টি লেখেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বেঞ্চের অপর বিচারপতি কাজী রেজাউল হক। তবে কনিষ্ঠ বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি ১২৫ পৃষ্ঠার এই রায়টি বাংলায় প্রদান করেন। তদন্তের নির্দেশ ॥ তুরাগ নদীর উভয় তীরের অবৈধ স্থাপনা এখনও আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। গাজীপুরের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে এ তদন্ত করতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আদেশ দেয়। আদালতে আজ আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস ও সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদা পারভীন। এর আগে গত ৯ নবেম্বর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তুরাগ নদীতে মাটি ভরাট ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। ওইদিন আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার জন্য বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি), পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক, গাজীপুর জেলা প্রশাসক, গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার, তুরাগ ও টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বলা হয়। একই সঙ্গে ওই এলাকায় মাটি ভরাট এবং দখলে যারা যুক্ত তাদের নাম-ঠিকানা তালিকা করে গাজীপুর জেলা প্রশাসককে তিন সপ্তাহের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জানান, ওই নির্দেশনা অনুযায়ী আজ নির্ধারিত দিনে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তবে ওই প্রতিবেদনের বিরোধিতা করে আমরা আদালতকে বলেছি যে, সংশ্লিষ্টদের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী তুরাগতীরে মাত্র ৯টি প্রতিষ্ঠান অবৈধ থাকতে পারে না। আদালতকে বিচারবিভাগীয় তদন্ত করার নির্দেশনা দেয়ার আর্জি জানাচ্ছি। পরে আদালত এই আদেশ দেয়।
×