কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদারের বার্তা দিয়ে গেলেন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর গোপালকৃষ্ণ প্রভু পারিকার। দুই দেশের সামরিক সহযোগিতাকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গেলে এ বিষয়ে একটি চুক্তি হতে পারে।
দুই দেশের মধ্যে সামরিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। সেই লক্ষ্যেই ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার বাংলাদেশ সফর করেন। দুদিন সফর শেষে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ছটায় ঢাকা ত্যাগ করেন।
ঢাকা ত্যাগের আগে বিকেল চারটায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন মনোহর পারিকার। বৃহস্পতিবার ভারতীয় হাইকমিশনারের বাসভবনে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সম্মানে এক মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়। সেখানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া তিনি ঢাকা সফরের সময় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফরের বিষয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সেসব আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি রয়েছে। এছাড়া ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন। সে প্রস্তাব অনুযায়ী দুই দেশের সামরিক বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নে ভারত সমর্থন দেবে বলে জানিয়েছেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রত্যাশা করছেন, তিনি (শেখ হাসিনা) যেন ভারত সফর করেন।
৪৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন। সে কারণে এই সফর নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়েছে, ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিবিড় সহযোগিতার সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা। চলতি মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য ভারত সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের পটভূমি তৈরি করারও ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফরের লক্ষ্য বলে খবরে বলা হয়।
এদিকে ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষাবিষয়ক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতির উপায় খুঁজতেই মনোহর পারিকারের এই সফর। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতি চীনের কৌশলগত পদক্ষেপ বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই সফর করছেন। মনোহর পারিকারের দুই দিনের আলোচনায় সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা- জোরদার করতে নতুন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামোর অংশ হিসেবে সামরিক সরবরাহ বাড়ানো, প্রযুক্তি হস্তান্তর, প্রশিক্ষণ ও যৌথ মহড়ার আয়োজন করা হবে।
আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাবেন। তখনই এ বিষয়ে একটি চুক্তি সই হতে পারে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের কাছ থেকে পাওয়া দুটি ডুবোজাহাজ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হয়েছে। দুটি ডুবোজাহাজই আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে আসবে। এই দুটির নাম রাখা হয়েছে ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’। এর পরই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাংলাদেশে এ সফর। গত অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ৩০ বছরে চীনের প্রথম কোন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসেন। সে সময় বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ২৭টি চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশে চীনের সামরিক প্রভাব ঠেকাতেই মনোহর পারিকারের এই সফর বলে আভাস দেয়া হয় এই প্রতিবেদনে।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সামনে রেখেই ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেন। দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার কাঠামো নিয়ে উভয়পক্ষই বিস্তারিত আলোচনা করবে। আলোচনার মাধ্যমেই বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী দিল্লী গেলে সেখানে এ বিষয়ে একটি চুক্তি সই হতে পারে।
এদিকে বৃহস্পতিবার আইএসপিআর থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সফররত ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বৃহস্পতিবার ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সশস্ত্র বাহিনীর বীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
তিনি শিখা অনির্বাণে পৌঁছলে সহকারী বিমান বাহিনী প্রধান (প্রশাসন) এয়ার ভাইস মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত তাকে অভ্যর্থনা জানান। পরে সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোঃ মাহফুজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী তার সফর সঙ্গীসহ চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি পরিদর্শন করেন। ভারতীয় প্রতিনিধি দলে ১১ সদস্য বাংলাদেশে আসেন। ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর উপপ্রধানগণ যথাক্রমে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতকালে তারা দু’দেশের বাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ক ও সহযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের এই প্রতিনিধিদলটি দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বুধবার বাংলাদেশে আসেন। ওইদিনই প্রতিনিধিদলটি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে বৈঠক হয়।