ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘দীপন শুধু নাম নয় মুক্তচিন্তার প্রতীক’

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১ নভেম্বর ২০১৬

‘দীপন শুধু নাম নয় মুক্তচিন্তার প্রতীক’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ উগ্রপন্থার আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত হয় মুক্তচিন্তা। মৌলবাদের চালিকাশক্তি জঙ্গীদের চাপাতির আঘাতে নিহত হন তরুণ প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। গত বছরের ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ প্রকাশনী সংস্থা জাগৃতির বিপণন কেন্দ্রে খুন হন মুক্তচিন্তা প্রগতিশীলতার ধারক এই প্রকাশক। সোমবার তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় এই প্রকাশক হত্যার বিচার দাবি করা হয়। সেই সঙ্গে উচ্চারিত হয় মৌলবাদকে মোকাবিলা করে প্রগতির সমাজ বিনির্মাণের কথা। স্মরণসভায় দীপনকে স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার প্রতীক হিসেবে আখ্যা দিয়ে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে, নেই জবাবদিহিতাও। যার ফলে মৃত্যুর এক বছর পরও দীপনের খুনিরা বা খুনের পরিকল্পনাকারীরা গ্রেফতার হয়নি, দেয়া হয়নি মামলার চার্জশীটও। দীপনের ব্যক্তিগত কোন শত্রু না থাকলেও, শুধু মুক্তচিন্তার বই প্রকাশের অপরাধে মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে। তারা অবিলম্বের দীপনসহ অন্যান্য ব্লগার, মুক্তচিন্তক ব্লগারদের খুনীদের গ্রেফতারের দাবি জানান। সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে দীপন স্মৃতি সংসদ আয়োজিত ‘দীপনের আলোতে প্রাণময়’ শিরোনামে স্মরণানুষ্ঠানে তারা এ কথা বলেন। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, মৌলবাদীদের হামলায় নিহত বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, শহীদ-জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, ‘সাপ্তাহিক’ সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করেন দীপন স্মৃতি সংসদের সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত। সঞ্চালনা করেন আবদুন নুর তুষার। অনুষ্ঠানে জাগৃতি থেকে প্রকাশিত ‘দীপন স্মারক গ্রন্থ’র মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। বইটি সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা। এতে বাচিকশিল্পী মাহিদুল ইসলাম নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, এক ধরনের কট্টরপন্থার মানুষ নিজেদের সমাজের অভিভাবক ভেবে কারা ধর্মচর্চা করছে না সেই তালিকা করছে এবং তাদের হত্যা করছে। আমরা এসব জঙ্গলের শাসন চাই না, আমরা সভ্য সমাজের মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই। দেশের পরিচালকদের কাছে এ দাবি। সেই সঙ্গে সকল মানুষের প্রতি আহ্বান আমরা একে একে অপরের হাতে হাত রেখে এই মানসিকতা রোধ করুন। যে কোন মানুষের ধর্ম পালন করা এবং পালন না করার অধিকার আছে। অথচ এ ধরনের হত্যাকা-ে রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা আমরা দেখছি না। তিনি আরও বলেন, ধর্ম পালনের এবং ধর্ম পালন না করার অধিকার দিয়েছে আমাদের সংবিধান। কেউ যদি ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে তবে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দেবে এমন বিধান রয়েছে। কিন্তু গুপ্তহত্যা করার স্বীকৃতি রাষ্ট্র দেয় না। এ অধিবার কারও নেই। আমরা অপেক্ষা করছি এই হত্যাকারী ও পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে কবে তাদের বিচার হয়। এটা দেখতে চাই সভ্যসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠার জন্য। এখানে আপোসের কোন জায়গা নেই। যারা নিজেদের সমাজের অভিভাবক মনে করে ধর্মহীন মানুষ হিসাবে প্রগতিশীল কিছু মানুষকে চিহ্নিত করে হত্যা করছে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোন হত্যার প্রতিকার হচ্ছে না। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে বাস করছি। এখানে বিচারের বাণী শুধু নিভৃতে কাঁদে না, বিচারের বাণী শুকিয়ে গেছে। আমাদের রাষ্ট্রে কোন জবাবদিহিতা নেই। আমাদের রাষ্ট্র, জনপ্রতিনিধিরা, আমলা, শিক্ষক, ব্যবসায়ীরা কারও মধ্যে জবাবদিহিতা নেই। তাই হত্যা বাড়ছে, অপরাধ বাড়ছে, শিশুরা, কিশোরীরা ধর্ষিত হচ্ছে। এমন রাষ্ট্র আমরা চাইনি। এর কারণ পরিষ্কার। শাসক বদল হয়েছে। কিন্তু শাসকের চরিত্র বদল হয়নি। সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে এ অবস্থা বদলাবে না। অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, এখন দীপন শুধু কোন নাম নয় স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার প্রতীক। দীপন আমার পুত্র অভিজিতের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সে অভিজিতের বই ‘অবিশ^াসের দর্শন’ প্রকাশ করেছে। অনেকে বলে থাকেন, দীপনকে হত্যার অন্যতম কারণ এই বই প্রকাশ। অভিজিৎ, দীপন, নিলয়, অনন্ত বিজয়Ñ এসব হত্যার পরে সরকারের প্রতিক্রিয়া আপনারা জানেন। এদের হত্যার পেছনে কট্টর মৌলবাদী দল। এদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা চোখে পড়ে না। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, নিজের পিতার মতোই দীপনের মধ্যে বড় মূল্যবোধের, আদর্শের স্বপ্ন ছিল। দীপন উচ্চতর জীবনপথের সৈনিক ছিলেন। আমার ছোট মেয়ের চেয়েও সে বয়সে ছোট ছিল, কিন্তু তারপরও আমি তাকে সম্মান করি। আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কেন মুক্তচিন্তা লেখকদের হত্যা করা হচ্ছে? কারণ, দীপন ব্যতিক্রমী মানুষ। সত্য প্রকাশ করে সমাজকে পরিবর্তনের পথে ধাবিত করাই ছিল দীপনের স্বপ্ন। আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, পুলিশ, র‌্যাব ও সরকারের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই। এসব হত্যাকা-ের পেছনে রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতির বিস্তার ওয়াশিংটন থেকে ঢাকা পর্যন্ত। এই অপরাজনীতি ৩৫ বছর ধরে চলছে। সরকার চেষ্টা করছে এই হিংস্র রাজনীতি দমন করতে। মামুনুর রশীদ বলেন, দীপন ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে মৃত্যু হয়নি। ধর্মনিরপেক্ষতার যারা শত্রু তারা দীপনকে হত্যা করেছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজই পারে মৌলবাদী সমাজকে প্রতিহত করতে। সে কারণে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। ইমরান এইচ সরকার বলেন, দীপনের মতো এ ধরনের হত্যাকা- বন্ধে কোন উদ্যোগ আমার দেখি না। রাষ্ট্রের বিচারহীনতার সংস্কৃতি বদলাতে হবে। রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। স্মরণসভায় শাহবাগ চত্বর থেকে কাঁটাবন চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কটির নাম ‘দীপন রোড’ করার দাবি জানান বক্তারা। সেই সঙ্গে ৩১ অক্টোবরকে ‘প্রকাশক দিবস’ হিসেবে ঘোষণারও দাবি জানানো হয় স্মরণ মঞ্চ থেকে। এই স্মরণ আয়োজনে আরও ছিল দীপনের জীবনের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী, জাগৃতির বাছাইকৃত বইয়ের প্রদর্শনী, দীপনের করা বইয়ের প্রচ্ছদ প্রদর্শনী, মঞ্চনাটক পরিবেশনা এবং দীপনের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছে বক্সঅফিস মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড। এদিকে ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার বিচার দাবিতে সকালে মানববন্ধন করেছেন রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে দীপনের সহকর্মীরা। মার্কেটটির সামনে এ মানববন্ধন আয়োজন করে আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেট দোকান মালিক ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি। এতে বক্তব্য রাখেন সমিতির সভাপতি নাজমুল আহসান, কোষাধ্যক্ষ কামাল হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মোরসালিন আহমেদ মিথুন প্রমুখ। এছাড়াও বিপণিবিতানের মালিক ও কর্মচারীরা কালোব্যাজ ধারণ করেন এবং বিপণিবিতানের মসজিদে দীপনের রুহের মাগফেরাত কামনায় বাদ আসর দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
×