নিখিল মানখিন ॥ গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে বয়স্ক নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। তাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা সীমিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখনও বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা সীমিত। বয়স্ক ও অন্য বয়সী রোগীর রোগ ও রোগের চিকিৎসার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। বয়স্ক হলে রোগই দেখা যায়, সুনির্দিষ্ট উপসর্গ থাকে না বা বয়স্করা সেগুলো ঠিকমতো অনুভব করেন না বা ভালভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। অনেক সময় দেখা যায়, খুব জটিল বা মারাত্মক অসুখে বৃদ্ধ রোগী সাধারণ অবসাদ, দুর্বলতা, অস্বস্তি এ ধরনের সমস্যার কথা বলছেন। এমন ক্ষেত্রে পরিবার থেকেও নজর দেয়া হয় না, এমনকি অনেক চিকিৎসকও যথার্থ মনোযোগ দেন না, হয়ত বার্ধক্যজনিত বলে মনে করেন। এভাবে অবহেলার ফলে অনেক রোগ নিরাময় সম্ভব হয় না। এর মূল কারণ বৃদ্ধদের সমস্যা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ও বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার অভাব। স্বাস্থ্যসহ সেবা খাতগুলোও এ মুহূর্তে এ চাপ টানতে সেভাবে প্রস্তুত নয়। সরকার অবশ্য ইতোমধ্যেই বয়স্ক নাগরিকদের জন্য বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে পিতা-মাতার ভরণপোষণ দিতে সন্তানদের বাধ্য করা হচ্ছে। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রবীণ দিবস।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে ২০১৩ সালে গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ বছর ১ মাস। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের তুলনায় গড়ে পৌনে তিন বছর বেশি বাঁচে। নারীর গড় আয়ু ৭১ দশমিক ৪ বছর। আর পুরুষের ৬৮ দশমিক ৮ বছর। বিবিএস বলছে, একজন বাংলাদেশীর গড় আয়ু ২০১০ সালে ছিল ৬৭ দশমিক ৭ বছর, ২০১১ সালে ৬৯ বছর ও ২০১২ সালে ৬৯ দশমিক ৪ বছর। বিশেষজ্ঞকদের মতে, মূলত শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, বাল্যবিবাহ প্রবণতা হ্রাস পাওয়া, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে উন্নতি হওয়ায় আমাদের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসব সূচকে অগ্রগতির ফলে প্রতি বছরই গড় আয়ু বাড়ছে। আমাদের আয়ুষ্কাল বাড়ছে, দৃশ্যত এটা ভাল খবর নিঃসন্দেহে। তবে এ সুখবরের পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, এ বিষয়ে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে যে সমস্যা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, সে অবস্থায় এক সময় আমরাও পৌঁছব। গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়বে। এখনই তা দৃশ্যমান। ঘরে ঘরে ষাট, এমনকি সত্তরোর্ধ বয়সের মানুষের দেখা মিলছে। আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবসরকালীন লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু তাদের জন্য নেই বিশেষায়িত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার সুব্যবস্থা।
দেশে প্রবীণদের সংখ্যা ॥ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্ব সমাজে বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে উদ্বেগজনক এবং বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থা হলো জনসংখ্যার বার্ধক্য। অথচ বহুকাল ধরে আমরা এ বিষয়ে খুবই অসচেতন, উদাসীন এবং নিষ্ক্রিয়। বাংলাদেশের প্রথম লোক গণনা রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৭৪ সালে এ দেশের ষাটোর্ধ প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৪০ লাখ ৫৬ হাজার ৯৫৮ জন। এ সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে ১৯৯১ সালের লোক গণনায় ৬০ লাখ ৪৫ হাজার ২৩ জনে পৌঁছায়। প্রবীণদের এ সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৫.৪২ শতাংশ ছিল।
বিশেষায়িত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা দরকার ॥ জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর নূরুন্নবী বলেছেন, গড় আয়ু বাড়ার ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যুর হার কমে যাওয়ার একটা সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি করছে। তাই দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের গড় আয়ু বাড়তে থাকায় বাংলাদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। এরও একটা প্রভাব ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে পড়তে পারে। তবে এখন থেকেই যে সরকার বয়স্কদের ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে, সেটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন এ জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ।
অধ্যাপক এম নূরুন্নবী আরও বলেন, আমাদের দেশে স্বাস্থ্যবীমা নেই। এছাড়া বয়স্কদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা দরকার হয়, সে ব্যবস্থা এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বয়স্করা বেশিরভাগই উপার্জনক্ষম নন। ফলে বয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটা সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
বয়স্কদের রোগ ও চিকিৎসা ॥ বয়স্কদের রোগ ও শারীরিক অবস্থার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, চুল পেকে যাওয়া, ত্বকে বলিরেখা, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়া, শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, সঙ্গে পেশী দুর্বল, হাড়ের ক্ষয় হয়, যকৃৎ এবং বৃক্কের কার্যক্ষমতা কমতে থাকা- বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রকম নানা সমস্যা দেখা দেয়। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে কিছু কিছু রোগ প্রকৃতিগতভাবে বয়স্কদেরই হয়ে থাকে। যেমন : তাদের রক্তনালি সরু হয়ে যায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদেরাগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ প্রভৃতি হতে পারে। প্রবীণদের মস্তিষ্ক ছোট হয়ে আসে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘ব্রেন এট্রফি’। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কেউ কেউ আলঝেইমার বা ডিমেনসিয়ায় আক্রান্ত হন। এসব রোগে স্মৃতিশক্তি কমে যায়। আবেগ, অনুভূতি, বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাশক্তি, চিন্তাক্ষমতা, কাজ করার ক্ষমতা ইত্যাদিতে পরিবর্তন আসে। আচার-আচরণে অনেকেই শিশুতে পরিণত হন। এছাড়া মাথাঘোরা, হাত-পা কাঁপা যাকে বলে ‘পার্কিনসন্স ডিজিজ’। মস্তিষ্কের নানা ধরনের রোগও প্রবীণদের মাঝে দেখা যায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাড় ক্ষয়ে যায়, যাকে বলা হয় অস্টিওপরোসিস। এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা বোধ করেন প্রবীণরা। মাঝেমধ্যে সামান্য আঘাতেই হাড় ভেঙ্গে যায় তাদের। চোখে ছানি পড়াটাও বয়স্কদের রোগ। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে প্রস্রাবের জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনেক বয়স্ক ব্যক্তির শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে তাদের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন : নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা ইত্যাদি।
এবিএম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, শুধু শারীরিক সমস্যা নয়, মানসিকভাবেও তারা অনেক সময় বিপর্যস্ত থাকেন। পরিবারে অনেক সময় প্রবীণরা অবহেলা-অযতেœর শিকার হন। কখনও কখনও নিজের সন্তানরাও তাদের বোঝা মনে করেন। তাই কারও কারও আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রমে। আমি মনে করি, বয়স্কদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার প্রধান কারণ হলো চিকিৎসা সুবিধার অভাব। আবার গ্রামের প্রবীণ আর শহরের প্রবীণের সমস্যা অনেক সময় ভিন্ন হয়।
প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি বিশেষায়িত বিভাগ। কিছু কিছু রোগ আছে যা শুধু বয়স্কদেরই হয়। তাই ওষুধ ও খাবার- দুটির ক্ষেত্রেই বয়স্কদের সতর্ক থাকতে হবে।
আমাদের দেশে এখনও বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা সীমিত। এ বয়সে অনেক রোগই দেখা যায়, সুনির্দিষ্ট উপসর্গ থাকে না বা বয়স্করা সেগুলো ঠিকমতো অনুভব করেন না বা ভালভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। অনেক সময় দেখা যায়, খুব জটিল বা মারাত্মক অসুখে বৃদ্ধ রোগী সাধারণ অবসাদ, দুর্বলতা, অস্বস্তি- এ ধরনের সমস্যার কথা বলছেন। এমন ক্ষেত্রে পরিবার থেকেও নজর দেয়া হয় না, এমনকি অনেক চিকিৎসকও যথার্থ মনোযোগ দেন না, হয়ত বার্ধক্যজনিত বলে মনে করেন। এভাবে অবহেলার ফলে অনেক রোগ নিরাময় সম্ভব হয় না। এর মূল কারণ বৃদ্ধদের সমস্যা সম্পর্কে বিশেষায়িত জ্ঞানের অভাব।
এবিএম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, প্রবীণরা যাতে স্বল্প ব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা লাভ করতে পারেন, সেজন্য পর্যাপ্ত হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারী হাসপাতালে তাদের জন্য আলাদা বিছানা বরাদ্দ থাকা উচিত। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধ তাদের বিনামূল্যে বা অল্প দামে দেয়া উচিত। এছাড়া প্রবীণদের চিকিৎসার জন্য বড় পরিবারের সদস্যদের বা ছেলেমেয়েদের মনে রাখা উচিত, তারা যেন তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।