ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নবাবদের ভোজনবিলাসের সংস্কৃতি পুরান ঢাকার ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৮ জুন ২০১৬

নবাবদের ভোজনবিলাসের সংস্কৃতি পুরান ঢাকার ঐতিহ্য

মোরসালিন মিজান ॥ খাবার যা চাই, হাতের কাছে। এর পরও না খেয়ে থাকা। পানাহারে বিরতি। এভাবে সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার মধ্য দিয়ে সংযমের শিক্ষা নেন রোজাদাররা। অনাহারী মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। সিয়াম সাধনার এই মৌলিক উদ্দেশ্যের কাছে ইফতার খুব গৌণ বিষয়। গৌণ বিষয় হওয়ার কথা। কিন্তু প্রায়ই তা হয় না। সারাদিন না খেয়ে থাকার পর অনেকেই একটু ভাল কিছু, বিশেষ কিছু খেতে চান। হ্যাঁ, ভোজনবিলাসী এই অংশটির জন্য চকবাজারের ইফতারের কোন তুলনা হয় না। পুরান ঢাকার বিপুল-বিশাল আয়োজন এখন ঐতিহ্যের অংশ। মুঘলদের খাবার, রাজা-বাদশাহ-নবাবদের ভোজনবিলাসের ইতিহাস তুলে ধরে চকবাজার। ঘরে ইফতারের যত আয়োজনই থাকুক না কেন, পুরান ঢাকার চকবাজার থেকে পছন্দের দুই-চার আইটেম না হলে কী যেন বাকি থেকে যায়। বিশেষ করে প্রথম রোজার দিনটিতে চকের ইফতার যেন বাধ্যতামূলক। পুরান ঢাকার মানুষ বাজারে ঢুঁ না মেরে থাকতে পারেন না। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসে। ইফতারসামগ্রী কিনে বাড়ি ফেরেন। সব মিলিয়ে অন্য রকম আবেদন নিয়ে হাজির হয় চকের ইফতার। মঙ্গলবার এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, প্রতিবারের মতোই উৎসবের আমেজ। জমজমাট বাজার। বাজার বলতে সরু একটা গলি। অন্য সময় গাড়ি-রিক্সা সবই চলে। এখন সেখানে দুই শ’র মতো দোকান। একদিকে চুলো পেতে ইফতারসামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে, অন্যদিকে চলছে বেচা-বিক্রি। যেমন বাহারী খাবার, তেমনি আকর্ষণীয় উপস্থাপনা। চেনা, অল্প চেনা ও অচেনা খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরছে সর্বত্র। ক্রেতাদের উপস্থিতি এত যে, পা ফেলার জায়গাও খুঁজে নিতে হয়। চকবাজারে ছোলা থেকে শুরু করে আচার পর্যন্ত আছে। দারুণ স্বাদের সঙ্গে আভিজাত্য যোগ হওয়ায় এসব খাবার আর সাধারণ থাকে না। চকবাজারে বিশেষ আকর্ষণ নানা রকমের কাবাব। বিখ্যাত সুতি কাবাব, জালি কাবাব, টিকা কাবাব, মুঠি কাবাব, এ্যারাবিয়ান কাবাবÑ কী নেই? বড় বাপের পোলায় খায়’ সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। দোকানিরা ব্যাপক হাঁকডাক করে বিক্রি করেন। তাদের বলাটি এ রকমÑ বড় বাপের পোলায় খায়/ ঠোঙ্গা ভইরা লইয়া যায়। সেলিম বাবুর্চি নামের এক দোকানি বেশ গৌরব করে বললেন, বড় বাপের পোলারা খাইতো। সেই জন্য এই নাম। রেসিপি বর্ণনা করে তিনি বলেন, গরুর মাথার মগজ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, গিলা, কলিজা, ডিম, আলু, ঘি, কাঁচামরিচ, শুকনো মরিচ, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেম ও ২৪ ধরনের মসলা দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। পিতলের বড় থালায় সবকিছু মাখিয়ে নিয়ে ঠোঙ্গায় ভরে বিক্রি করা হয়। বিচিত্র উপস্থাপনার কারণে দারুণ চোখে পড়ে সুতি কাবাব। কাবাবের পুরোটা সুতো দিয়ে বাঁধা থাকে বলেই সুতি কাবাব নাম। সরু পাইপের মতো দেখতে। মাঝখানে লোহাড় শিক ঢুকিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ক্রেতা চাইলে একপাশ থেকে কেটে বিক্রি করা হয়। ৩০ বছর ধরে সুতি কাবাব তৈরি করেন হান্নান মেম্বার। বললেন, নওয়াবরা খাইত। বহুত পুরানা জিনিস। আমাগো বড় বাবারা করত। এহন আমরা করি। এখানে গরুর মাংসের সুতি কাবাব বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা কেজি দামে। খাসির সুতি কাবাব ১০০০ টাকা কেজি। কেউ কেউ খাসির রান রান্না করে নিয়ে এসেছেন। মাংসের গায়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন সালাদের আইটেম। কিছু সময় পর পর উপর থেকে ঢালা হচ্ছে তরকারির ঝোল। তাতেই অদ্ভুত চিক চিক করে উঠছে খাবারটি! লোভনীয় এই ইফতারসামগ্রীর নামÑ লেগ রোস্ট। ছোট ছোট পাখিও রোস্ট করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নাম দেয়া হয়েছে ‘ভিজা রোস্ট।’ কবুতর আছে যথারীতি। বেশি দেখা যায় কোয়েল। কারও কারও দৃশ্যটি দেখে খারাপ লাগে বৈকি! তবে বেচা-কেনা বন্ধ থাকে না। চকে আস্ত খাসিকেও দিব্যি রোস্ট করে ফেলা হয়। তার পর বিশেষ ব্যবস্থায় বসিয়ে দেয়া হয় টেবিলের উপর। দেখলে মনে হয়, এই বুঝি ছুট দেবে। আদতে সে সুযোগ নেই। দেহের আদল ঠিক থাকলেও এটি আসলে সুস্বাদু খাবার। নামÑ আনাম খাসি। অবশ্য প্রথম রোজায় আনাম খাসি তেমন চোখে পড়েনি। পরবর্তী রোজায় এটি হয়ত পাওয়া যাবে। বাজার ঘুরে আরও দেখা গেল, তেহারি, মোরগ পোলাও, কাচ্চি, কিমা পরোটার দোকান। শাকপুলি, ডিমচপ, বিভিন্ন ধরনের কাটলেট আছে। দই বড়া, মোল্লার হালিম, নুরানি লাচ্ছি, পনির, পেস্তা বাদামের শরবত, লাবাং, কাশ্মীরী শরবত, ছানা মাঠাও বেশ চলছে। কিছু খাবার আবার একদমই সাধারণ। কিন্তু স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়। কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন দিতে দেখা যায়। তেমন একটি খাবারের নাম কাচুরি। ছোট পুরির মতো দেখতে। ময়দা দিয়ে তৈরি কাচুরি তেলে ভাজা হচ্ছে। কাজটি করছিলেন মাঝবয়সী কারিগর মানিক। জনকণ্ঠককে তিনি বলেন, কাচুরির ভেতরে ঘুমনি, সালাদ, টক দই ইত্যাদি দিয়ে খেতে হয়। পুরান ঢাকার মানুষ বহুকাল ধরে এই খাবার খাচ্ছেন। রমজান ছাড়া সারাবছর এটি কোথাও পাওয়া যায় না। ৪৫ বছর ধরে কাচুরি তৈরি করছেন বলে জানান তিনি। চকের শাহী জিলাপীও খুব বিখ্যাত। এর বিশাল আকার। এক কারিগর দোকানের পেছনের অংশে বসে জিলাপী ভাজছিলেন। হাঁটু ভেঙ্গে আরাম করে বসে ডুবো তেলে প্যাঁচ কষছিলেন তিনি। কখনও পাঁচটি, কখনও ছয় থেকে সাত প্যাঁচ। বললেন, সবচেয়ে ছোট জিলাপী হয় আড়াই প্যাঁচের আর বড় জিলাপী ২০ প্যাঁচ পর্যন্ত হয়। প্রতিটি জিলাপীর ওজন এক কেজি থেকে চার কেজি পর্যন্ত হয়ে যায়। চকের এখানে-ওখানে আরও সাজানো আছে দই বড়া, ফালুদা, মাঠা, লাবাং ইত্যাদি পানীয়। আর ছোলা-মুড়ি তো না থাকলেই নয়। অসংখ্য আইটেমের ইফতার বাজার থেকে যার যা পছন্দ কিনছিলেন। কাকরাইলের বাসিন্দা আসিফ বললেন, প্রথম রোজায় চকে না এলে হয় না। বাপ-দাদারা আসতেন। সেই রেওয়াজ এখনও মানি। পলাশী থেকে চকে ইফতার কিনতে এসেছিলেন আশরাফুল ইসলাম। বললেন, ইফতার তো সারা ঢাকায় হয়। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার আছে যেগুলো চক ছাড়া পাওয়া যায় না। এ কারণেই চকে আসা। রমজানের পুরোটাজুড়েই এই আসা-যাওয়া অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
×