ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নপুরী গ্লাসগো

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

স্বপ্নপুরী গ্লাসগো

জাদুঘর চালু হয়েছে সেই ১৮৯৮ সালে! সেই সঙ্গে ক্যাফে ও খোলা উদ্যান এবং ছোট বাগান রয়েছে। জাদুঘরে স্কটিশ জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গের বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে। জাদুঘরের এক কোনায় চোখে পড়ল কিছু মারাত্মক অপরাধের বিবরণ দিয়ে দর্শনার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদ- নাকি মৃত্যুদ- হওয়া উচিত? জনতার প্রাসাদের পাশেই ফোয়ারা এবং দৃষ্টিনন্দন গ্লাস হাউস। তারপর পথে চলতে চলতে গ্লাসগোর ইতিহাস জেনে নেয়া, আধুনিক কিছু স্থাপনা যেখানে মূলত কনসার্ট বা এই ধরনের অনুষ্ঠান হয় দেখে নিয়ে রিভার সাইড মিউজিয়ামে হাজির হওয়া। ক্লাইড ও কেল্ভিন নদীর নাটকীয় সঙ্গমস্থলে গড়ে ওঠা এই যানবাহন সমৃদ্ধ জাদুঘরটি চালু হয় ২০১১ সালে রাইসুল সৌরভ যুক্তরাজ্যে আসার পর এখনও কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নতুন এসে আবশ্যিক কিছু কাজ, ক্লাস আর ঘুমিয়েই দিব্যি চলে যাচ্ছিল! আফসোস হচ্ছিল ইউরোপে পদচিহ্ন ফেলে এখনও কোথাও দেখা হয়ে উঠল না; এমনকি স্কটল্যান্ডের আমি যে শহরের বাসিন্দা সেই স্টারলিংও ঘুরতে বের হয়ে ওঠা হয়নি এখনও। তাই নিজেই ঠিক করলাম আসছে সপ্তাহান্তে ঘুরে আসি গ্লাসগো থেকে। স্টারলিংয়ের অবস্থান মূলত এডিনবরা আর গ্লাসগোর মাঝামাঝি, যেতেও কাছাকাছি সময় লাগে আর রেলের ভাড়াও প্রায় সমান। তাই ভাবলাম ফিরতি সপ্তাহে না হয় স্কটিশ রাজধানী দেখে নেয়া যাবে। যাওয়ার আগের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে অনলাইনে দেখে নিলাম কিভাবে ঘোরা যেতে পারে সেই সঙ্গে গ্লাসগোতে বসবাসরত ক্লাসের এক সহপাঠীর কাছ থেকে জেনে নিলাম বাড়তি কিছু তথ্য। বাসার পাশের রেলস্টেশন থেকেই সকাল সকাল শুরু করলাম যাত্রা। ছোটখাট, শান্ত নিরিবিলি স্টেশন; গোটাকতক যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায়। স্টেশনে বসানো মেশিন থেকে যে যার চাহিদামতো টিকেট কেটে নিয়ে অপেক্ষা করছে। একটু পরপর রেলের অবস্থান, কোন বিলম্ব আছে কিনা প্রভৃতি ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসবের ফাঁকেই একদম ঘড়ি ধরে চলে এলো আমাদের ট্রেন! গ্লাসগোর কুইন স্ট্রিট স্টেশন আকারে বেশ বড়, হঠাৎ করে নেমে অনেকটা শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশন বলে মনে হয়। ট্রেন থেকে নেমেই যে যার যাত্রায় হনহন করে ছুটে চলছে। তবে এখানকার স্টেশনের পার্থক্য হলো এখানে ঢোকা বা বের হবার সময় ইলেকট্রিক গেটে টিকেট পাঞ্চ করার পরই প্রবেশ বা বহির্গমনের অনুমতি মেলে; ফলে টিকেটহীন রেলযাত্রা চাইলেও সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর এদের রেলকেও তাই দিনের পরদিন ভর্তুকি দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলতে হয় না। স্টেশন থেকে বের হয়ে ভিন্ন এক জগতে এসে পড়লাম যেন; লোকসমাগমও প্রচুর, অন্তত আমার স্টারলিং শহরের তুলনায় ঢের বেশি। অনেকটা আমাদের ফার্মগেটের মতো জন¯্রােত ছুটে চলছে আপন গন্তব্যে। দূর থেকে গানের বাজনা ভেসে আসায় সেদিকে একটু আগাতেই চোখে পড়ল রাস্তার মাঝখান দখলে নিয়ে কয়েকজন ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ভীষণ আওয়াজে ও আমোদে চালিয়ে যাচ্ছে গান-বাদ্য। তাদের দেখতে চারপাশে গোল হয়ে ভিড় জমিয়েছে মানুষজন। কেউ কেউ মুঠোফোনে ছবি তুলে যাচ্ছে কেউ বা যেচে যেয়ে পাউন্ড বা পেন্স দিয়ে আসছে। সেসব রেখে আমি চললাম স্টেশনের পাশে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আমার উদ্দেশ্য তখন অনলাইনে দেখে আসা লাল রঙের দ্বিতল ছাদখোলা বাস খুঁজে বের করা। যারা মূলত মূল্যের বিনিময়ে হপ অন ও অফ সার্ভিসের মাধ্যমে আগন্তুকদের শহর ঘুরিয়ে দেখায়। প্রতি পনেরো মিনিট পরপর লাল টুকটুকে এই সিটি সাইটসিয়িং বাস পর্যটকদের নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দেয় ও তুলে নেয়। হপ অন ও অফ সার্ভিসের সুবিধা হলো বাস কোথাও নামিয়ে দেয়ার পর ওই জায়গা ঘুরেটুরে এসে আবার বাসস্টপে এসে দাঁড়ালে একই প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন কোন বাসে টিকেট দেখিয়ে চড়ে পরের গন্তব্যে চলে যাওয়া যায়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায় কোন এক জায়গায় যেয়ে সেই প্রথম বাসের চালক বা গাইডের সঙ্গে পুনরায় দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায়। বাসে সাধারণত অডিও ধারাবর্ণনা থাকে। বাস চলতে চলতে কানে হেডফোন লাগিয়ে আগাম গন্তব্য সম্পর্কে জেনে নেয়া যায়। সে বর্ণনায় শহরের ইতিহাস থেকে শুরু“করে কোন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বা স্থাপনার বিবরণ আর যেখানে মূল লক্ষ্য করে যাওয়া সেখানকার প্রেক্ষাপটতো থাকবেই। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বাস চলতে চলতে যখন যেখান দিয়ে যায় ধারাবর্ণনাও এমনভাবে সেট করা থাকে যে ঘোষক আগে থেকে কথা চালিয়ে আসলেও ঠিক সেই জায়গাতেই সেই নির্দিষ্ট বর্ণনা চলে আসে। যেন পথের দূরত্বের সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা, বাসের গতি সবই কাঁটায় কাঁটায় মেলানো; ন্যূনতম ব্যত্যয় নেই! কোন বাসে অডিও শোনার ব্যবস্থা না থাকলে জীবন্ত গাইডই নিজের গলায় শুনিয়ে দেয় সেসব। বাসে করে এমনিতে পুরো শহর ঘুরে দেখতে সময় লাগবে এক ঘণ্টা বিশ মিনিটের মতো। যাত্রার শুরুতেই নিয়ে গেল গ্লাসগো গোরস্তানে! যেখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার স্বতন্ত্র সমাধি রয়েছে। পাহাড়ের চূড়ার দিকে এই সমাধিগুলো অবস্থিত। সমাধি চিহ্নিত করতে বানানো রয়েছে নানা রকম আর আকৃতির ভাস্কর্য। কোন কোনটিতে মৃত ব্যক্তির ঢাউস ভাস্কর্য সঙ্গে জন্মমৃত্যুর তথ্য। পাশেই রয়েছে চার্চ ও ধর্মীয় জাদুঘর। চার্চের এক কোনায় শীতবস্ত্র থেকে শুরু করে ধর্মীয় নানা জিনিস বিকিকিনির ব্যবস্থা। জাদুঘরসহ প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই এই ব্যবস্থা চোখে পড়েছে। তবে অনেক টাকা (নাকি পাউন্ড?) খরচ করে বিভিন্ন স্থাপনা ও জাদুঘর তৈরি করলেও কোথাও প্রেবেশের জন্যই আলাদা করে টিকেট কাটা লাগেনি, বাসে করে ঘোরার খরচই সই। বাসে করে একুশটি জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর কথা থাকেলেও তন্মধ্যে অনেক জায়গায়-ই নামার প্রয়োজন পড়ে না। ছাদখোলা বাসের দোতলাতে বসেই দেখে নেয়া যায়। এই যেমন রাস্তার পাশে বড় কোন ভবন, বাজার, বিশেষ এলাকা বা বিখ্যাত কোন হোটেল বা বাড়ির দেয়ালে আঁকা শিল্পকর্ম। এভাবেই তাই কেটে গেল পরবর্তী কয়েকটি জায়গা। এরপর যেখানে যেয়ে নামলাম সেই জায়গার নাম জনতার প্রাসাদ (মানে পিপল’স প্যালেস)। মূলত এই জাদুঘর চালু হয়েছে সেই ১৮৯৮ সালে! সেই সঙ্গে ক্যাফে ও খোলা উদ্যান এবং ছোট বাগান রয়েছে। জাদুঘরে স্কটিশ জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গের বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে। জাদুঘরের এক কোনায় চোখে পড়ল কিছু মারাত্মক অপরাধের বিবরণ দিয়ে দর্শনার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদ- নাকি মৃত্যুদ- হওয়া উচিত? জনতার প্রাসাদের পাশেই ফোয়ারা এবং দৃষ্টিনন্দন গ্লাস হাউস। তারপর পথে চলতে চলতে গ্লাসগোর ইতিহাস জেনে নেয়া, আধুনিক কিছু স্থাপনা যেখানে মূলত কনসার্ট বা এই ধরনের অনুষ্ঠান হয় দেখে নিয়ে রিভার সাইড মিউজিয়ামে হাজির হওয়া। ক্লাইড ও কেল্ভিন নদীর নাটকীয় সঙ্গমস্থলে গড়ে ওঠা এই যানবাহন সমৃদ্ধ জাদুঘরটি চালু হয় ২০১১ সালে। দেখে মনে হয় ধীরলয়ে বয়ে যাওয়া নদী; কোন ব্যস্ততা নেই তাদের। অনন্তকাল ধরে বয়ে যেতে যেতে বয়সের শেষ সীমায় এসে শান্ত-সৌম রূপ নিয়েছে যেন। খুবই সুস্থিরভাবে বয়ে চলছে আপন ইচ্ছার ভেলায় ভেসে। অযান্ত্রিক, যান্ত্রিক এমন কোন যান নেই, যার দেখা এই নদীর তীরের জাদুঘরে নেই। বরং, নানা ঢং আর আকারের যানে ঠাসা এই জাদুঘর। সেখানে গেলে দেখা যাবে ঘোড়ার গাড়ি, রেলের নানা সংস্করণ, মোটরসাইকেলের বিবিধ রূপসহ হরেক রকমের কার আর বাস। এসবের মধ্যে এককোণে চলছে গাড়ি নিয়ে শিশুদের খেলাধুলার আয়োজন এবং চিত্রাঙ্কনের ব্যবস্থা। এখানকার বাস, রাস্তা থেকে শুরু করে সমস্ত জায়গাতেই ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড পার্সনদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা। তাই ঘুরতে কাউকেই তেমন বেগ পেতে হয় না। জাদুঘর লাগোয়া নদীতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছে এক জাহাজ। সেখানেও স্মারক বিকিকিনির ব্যবস্থা থাকলেও জাহাজে চড়তে কোন ফি লাগল না। জাহাজে উঠে নানা দেশের পর্যটকরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলে যাচ্ছে। সেসব দেখে বেরিয়ে বাসস্টপে এসে সেই লালরঙা ছাদখোলা বাসের জন্য অপেক্ষা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরই দেখা মিলল কাক্সিক্ষত বাসের। পুনরায় ধারাবিবরণীসহ বাস আবার শহরের বুক চিরে ছুটে চলল গ্লাসগোর অন্যতম আকর্ষণ কেলভিনগ্রোভ আর্ট গ্যালারি ও মিউজিয়ামের পানে। এই জাদুঘরের একেক তলার একেক প্রান্তে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গ্যালারি। কোন পাশে স্কটিশ প্রাণীর পসরা তো অন্যপাশে বিজ্ঞান, আবার হয়ত একপাশে চোখে পড়বে চিত্রশালা। এসব দেখার ফাঁকে ফাঁকেই চলতে চলতে দেখা মিলবে দারুণ কিছু ভাস্কর্যের। পরের গন্তব্য গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটা ঘুরে দেখার সুযোগ না পেলেও কিছু অংশ ও আবারও একটি জাদুঘর দেখার সুযোগ মিলল। জাদুঘরে ঘুরতে ঘুরতে একপর্যায়ে ক্লান্তির সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তিও পেয়ে বসেছিল। যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই কেবল জাদুঘর আর জাদুঘর! নগরায়ন আর স্বল্প সময়ের ভ্রমণের দরুন হয়ত গ্লাসগোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখে পড়েনি খুব একটা। ইউরোপের অন্যতম পুরনো নগর হলেও খুব সমৃদ্ধ পর্যটনস্থল চোখে পড়েনি এই দফার ভ্রমণে। মনে হয়েছে নিজেদের বানানো কিছু জাদুঘরই এই শহরকে পর্যটকদের সামনে মেলে ধরার একমাত্র সম্বল। চোখ ও মনের খুব প্রশান্তি না হলেও নিয়ত ছুটে চলা মানুষের দল দেখে মনে হয়েছে নাগরিকতা আর জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা ব্যস্ত জীবন এই শহরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরতে পেরেছে ঠিকই।
×