ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানে চিনি সরবরাহের প্রস্তুতি দেশবন্ধু সুগার মিলসের

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২

রমজানে চিনি সরবরাহের প্রস্তুতি দেশবন্ধু সুগার মিলসের

দেশবন্ধু সুগার মিলস

  • নতুন করে ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ
  • র’সুগার আমদানিতে এলসি সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি

রমজান মাস সামনে রেখে বাজারে চাহিদা মতো চিনি সরবরাহের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশবন্ধু সুগার মিলস। এলক্ষ্যে র’সুগার আমদানিতে দ্রুত এলসি বা ঋণপত্র খোলার তাগিদ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, কাঁচামাল সঙ্কটে মিলের চিনি উৎপাদন ক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। 

এখন উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশেষ করে রমজানে পর্যাপ্ত পরিমাণে চিনি সরবরাহে প্রতিষ্ঠানটি এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়েছে। শনিবার নরসিংদীর শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত দেশবন্ধু সুগার মিল সরেজমিনে পরিদর্শন করে গণমাধ্যম কর্মীরা। এরপরই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে একটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়-গত একবছরে দেশবন্ধু গ্রুপ নতুন করে ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এরফলে গ্রুপের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়েছে। শুধু তাই নয়, চিনি উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ টনে। কিন্তু কাঁচামাল সঙ্কটে তাদের সেই উৎপাদন এখন দেড়শ থেকে ২০০ টনে নেমে এসেছে। 

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়-মহামারি করোনায় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগে। এতে ছোট-বড় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কর্মী কাজ হারিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম এখনো বন্ধ রয়েছে। তবে করোনার সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু গ্রুপ। নানা রকম প্রতিকুল পরিবেশ সত্ত্বেও করোনার শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোনো কর্মীর কাজ হারাতে হয়নি। 

উল্টো গত এক বছরে প্রায় পাঁচ হাজার নতুন কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। অর্থাৎ গতবছর গ্রুপের অধিনে কাজ করতো ২০ হাজার মানুষ। বর্তমানে তা বেড়ে ২৫ হাজারে পৌছেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসা বাড়াতে উৎপাদমুখী নানা প্রকল্প হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশবন্ধু গ্রুপ। 

এই লক্ষ্যে গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু সুগার মিলস, সাউথ ইস্ট সোয়েটার, জিএম অ্যাপারেলস, বেভারেজ, প্যাকেজিং ও দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলসসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে গত বছর ৮০০ কোটি টাকা নতুন করে বিনিয়োগ করে দেশবন্ধু গ্রুপ। 

এতে নতুন করে আরো ২৫ শতাংশ কর্মসংস্থান বেড়েছে। গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ২৪০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৮০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যার প্রবৃদ্ধি হার ১৪ শতাংশ। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়লেও প্রত্যানুযায়ী উৎপাদন ও বিক্রি কার্যক্রম অর্জিত হয়। কারণ গত বছর ৮০০ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগের শুরুতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সারা বিশ্বে নেমে আসে নতুন করে আর এক বিপর্যয়। করোনা শঙ্কা যেতে না যেতেই শুরু হয় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা। এর প্রভাবে দেশে ডলারের দামে রেকর্ড হয়। ডলারের অধিক মূল্য বৃদ্ধিতে কাঁচামাল আমদানিতে বড় ধাক্কা লাগে। কমতে থাকে রির্জাভ। শুরু হয় ডলার সংকট। এ কারনে বন্ধ হয়ে যায় এলসি। একের পর এক কমতে থাকে বায়ারদের ক্রয় আদেশ। নতুন করে যুক্ত হয় গ্যাস সংকট, জ্বালানী ও বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততার সঙ্গে চড়া দাম বৃদ্ধি। হুহু করে বাড়তে থাকে পরিবহন ভাড়া। 

এছাড়া মূল্যস্ফীতির মতো এরকম শত সমস্যার সত্ত্বেও গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি। নিয়মিত কর্মকর্তা-কর্মচারিরা বেতন -ভাতা পেয়েছেন। একজন কর্মীও চাকরি হারায়নি। উল্টো গ্রুপের সব প্রতষ্ঠান মিলে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এমনকি ব্যাংক ঋণের কিস্তি সিমিত হলেও নিয়মিত পরিশোধ করে যাচ্ছে গ্রুপটি। কারণ সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখছে দেশবন্ধু গ্রুপ। 
   
বর্তমানে চিনির দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দাম বেঁধে দেয় সরকার। তবে সরকারি নির্ধারিত দামে রাজধানীর কোনো দোকানে বিক্রি হতে দেখা যায়নি। এমতাবস্থায় নির্ধারিত দামে টিসিবির আদলে সাধারণ মানুষের জন্য ট্রাকে করে রাজধানীতে চিনি সরবরাহ করে যাচ্ছে দেশবন্ধু সুগার মিলস।

দেশবন্ধু গ্রুপ জানায়, চলতি বছরে উত্তরবঙ্গের চাহিদানুযায়ী দেশবন্ধু সিমেন্ট কারখানার সম্প্রসারণের উদ্যেগ নিয়েছে। যা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারের কোষাগারে জমা হবে মোটা অংকের ভ্যাট ও ট্যাক্স। রাজধানীর উত্তর খান দেশবন্ধু গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সাউথ ইস্ট সোয়েটার লিমিটেড ও জিএম অ্যাপারেলস লিমিটেড। 

গত বছর বাণিজ্য কার্যত্রুমের উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি তখন বলেছিলেন, দেশবন্ধু আসলেই দেশ ও জনগণের বন্ধু। মহামারি করোনার মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের গ্রুপের সব কার্যক্রম চলমান রেখেছেন। গ্রুপের প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফার লক্ষ্যই হলো দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো। 

একই সঙ্গে দেশের গতিময় অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। চলমান শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন শিল্প স্থাপন অব্যাহত রেখেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। এতে করে বেসরকারি খাতে ব্যাপক অবদানসহ কর্মসংস্থান, উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে দেশবন্ধুগ্রুপ আরো অগ্রসর হবে বলে আশা করছেন কর্তৃপক্ষ। সরেজমিনে দেখা গেছে, দেশবন্ধু গ্রুপের নরসিংদীর চরসিন্দুর পলাশ শিল্প এলাকায় অবস্থিত সব কারখানায় চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।এ সময় সাংবাদিকরা কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।  

সার্বিক বিষয়ে দেশবন্ধু গ্রুপের পরিচালক (প্রশাসন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাকির হোসেন বলেন, করোনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশই বিপর্যস্ত। সেই ধাক্কা কাটতে না কাটতে শুরু হয় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে সারাবিশ্বে আমদানি-রপ্তানিতে বিরুপ প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো শুধুমাত্র রপ্তানি নির্ভর। সে সব কোম্পানি দারুণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যুদ্ধের কারনে। এমন বাস্তবতা সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অব্যাহত রেখে দেশ ও দেশের মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে দেশবন্ধু গ্রুপ। তিনি বলেন, শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, রপ্তানিকৃত সব ধরনের পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে দেশবন্ধু। জাকির হোসেন বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপ একটি মানবিক ও কর্মীবান্ধব প্রতিষ্ঠান। 

এদিকে খুব অল্প সময়েই দেশবাসীর মন জয় করেছে দেশবন্ধু বেভারেজের সব ধরনের পণ্য। বিশেষ করে দেশবন্ধু মিনারেল ওয়াটার সারাদেশে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করতে পেরেছে। ফলে গত বছরে দেশবন্ধু বেভারেজ কারখানার নতুন সেকশনসহ সার্বিক উন্নয়নে করোনার মধ্যেই ২০০ কোটি টাকার বেশি নতুন বিনিয়োগ করে। 

কারখানায় উন্নত প্রযুক্তির ইটালিয়ান মেশিনারিজ স্থাপন করা হয়। চলতি বছরের মধ্যেই উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ধীরগতিতে চলছে উৎপাদন কাজ। তবে কারখানার নতুন মেশিনারিজে  পুরোদমে উৎপাদন শুরু হলে প্রতিঘন্টায় উৎপাদন হবে ৭৫ হাজার (বিপিএইচ) বোতল। অর্থাৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ৬৫ শতাংশ। সেক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান হবে প্রায় ১৫০০ মানুষের। দেশবন্ধু বেভারেজের কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মারুফ হোসেন বলেন, দেশবন্ধু ফুড অ্যান্ড বেভারেজ দেশবন্ধু গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। কোনো অবস্থাতেই পণ্যের মানের বিষয়ে ছাড় দেওয়া হয় না। শতভাগ কোয়ালিটি বজায় রেখে নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন পণ্যের মাণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।  দেশবন্ধু প্যাকেজিং ও পলিমার লিমিটেডের প্রধান (বৈদেশিক বিপণন) মো. শফিউল আজম তালুকদার বলেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে দেশবন্ধু গ্রুপ পালন করছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশের গন্ডি পেরিয়ে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে আনছে বৈদেশিক মুদ্রা।

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত গ্রুপের একমাত্র প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু পলিমার। সরেজমিনে দেখা গেছে, পলিমারের উৎপাদন কার্যক্রম বেশ গোছালো ও আন্তরিকতার সঙ্গে করছেন কর্মীরা। দেশবন্ধু পলিমারের মহাব্যবস্থাপক ইঞ্জিনিয়ার সাখাওয়াত হোসেন জানান, দেশবন্ধু সুগার মিলস চালু হওয়ার পর মোড়কের জন্য প্রতি বছর ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ চিনির ব্যাগ প্রয়োজন হয় সেই প্রেক্ষিতে ২০০৬ সালে দেশবন্ধু পলিমার কারখানা স্থাপন করা হয়। প্রথমে তাইওয়ানের মেশিনারি দিয়ে স্বল্প পরিসরে অর্থাৎ বার্ষিক এক কোটি ব্যাগ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন মিল স্থাপন করা হয়। পরবর্তী সময়ে আরো মেশিনারিজ সংযোজনের মাধ্যমে ২০১৩ ও ২০১৬ সালে আরো উৎপাদন বৃদ্ধি করে সিমেন্ট ব্যাগসহ বর্তমানে এর উৎপাদন ছয় কোটি ব্যাগে উন্নত করা হয়েছে। 
 

এম শাহজাহান

×