ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

বিদেশী সবজি চাষ

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ২২ মে ২০২২

বিদেশী সবজি চাষ

বাণিজ্যিকভাবে সবজির চাষ বেড়েছে। উৎপাদনও বাড়ছে প্রতিবছর। সবজি চাষে দেশে বিপ্লব হয়েছে। বর্তমানে শুধু সবজিই চাষ করেন এমন কৃষক অনেক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) কর্মকর্তারা জানান, একসময় দেশের বিশেষ কয়েকটি জেলাতে বড় পরিসরে সবজির চাষ হতো। বর্তমানে সব জেলাতেই সারাবছর সবজির চাষ হচ্ছে। দেশে ৬০ ধরনের ও ২ শতাধিক জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। নানা পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। নতুন নতুন জাত এসেছে। যে কারণে সারাবছর সবজি পাওয়া যাচ্ছে। দেশের পাশাপাশি বিদেশের বাজারের জন্য সবজি উৎপাদন করছেন চাষীরা। ভাল লাভও পাচ্ছেন। ফলে শিক্ষিত তরুণরাও ঝুঁকছেন সবজি চাষে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সবজি উৎপাদনের হার বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। রফতানির বড় উৎস প্রবাসী বাংলাদেশীরা রফতানির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের সবজি রফতানি শুরু হলেও ২০০০ সালের পর থেকে বিশ্ববাজারে ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা। বর্তমানে নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, মীরসরাই, যশোর, বগুড়া, রাজশাহী, মাগুরা, মৌলভীবাজার, দিনাজপুর, কক্সবাজার, সিলেট ও গাজীপুরের সবজি রফতানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। বিদেশে বাংলাদেশের শাকসবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চাহিদার মাত্র ২ থেকে ৫ শতাংশ রফতানি করতে পারছেন উদ্যোক্তারা।পণ্য পরিবহনে নানান অসুবিধা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাক-সবজি রফতানি করে ৬৫০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৫০ দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রফতানি হয়। যেসব দেশে বাংলাভাষীরা বসবাস করছে, সেসব দেশে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা বেশি। দেশের রফতানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যায়। কার্গো বিমান চালু, বিদেশী বিমানগুলোয় পণ্য রফতানির ব্যবস্থা গ্রহণ, যেসব দেশে এসব পণ্যের বাজার আছে সেসব দেশে ফ্লাইট বাড়ানো, চলমান ভর্তুকি অব্যাহত রাখাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া গেলে ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ খাতে পণ্য রফতানির মাধ্যমে আরও অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তথ্য উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সবজির ভাল চাহিদা থাকায় দিন দিন বেড়ে চলেছে সবজি রফতানি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রবৃদ্ধির এ হার বজায় থাকলে আগামীতে সবজি রফতানি খাতে আয় ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। দেশের মাটিতে বিদেশী সবজি দেশে প্রচুর চাহিদা থাকায় নিজ তাগিদে বিদেশী সবজি চাষ করছেন কৃষকরা। এসব চাষে কোন প্রশিক্ষণ নেই তাঁদের। নিজেরাই বীজ সংগ্রহ করে নেমে পড়েছেন চাষে। বিদেশী এসব সবজি সাধারণ মানুষ যেমন ক্রয় করে পাশাপাশি রেস্টুরেন্টগুলোতেও চাহিদা রয়েছে। ফলে কৃষকরা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। সরবরাহ করছেন সারাদেশে। লেটুসপাতা, চায়নিজ পাতা, ক্যাপসিকাম, বিট রুট, ব্রকলি, রেড ক্যাবেজ, স্কোয়াশ, ফ্রেঞ্চ বিন, সুইট কর্ন, বেবি কর্ন, থাই আদা, থাই তুলসী, লেমনগ্র্যাস, স্যালারি পাতা, শিমলা মরিচ, চায়নিজ ক্যাবেজ- খেতের পর খেতজুড়ে চলছে এসব বাহারি বিদেশী সবজির চাষ। বগুড়ার তিনটি উপজেলা শিবগঞ্জ, গাবতলী ও শাজাহানপুর ঘুরে দেখা যায়, খেতের পর খেতজুড়ে চলছে বিদেশী সবজির চাষ। উপজেলার কয়েকটি গ্রামে বছরে গড়ে ৪০০ মেট্রিক টন (১০ হাজার মণ) বিদেশী সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। বগুড়ায় উৎপাদিত এসব সবজি যাচ্ছে রাজধানীর শেরাটন, সোনারগাঁও, ওয়েস্টিনের মতো তারকা হোটেলে। সুপার শপগুলোয় যেসব বিদেশী সবজি থরে থরে সাজানো থাকে, সেগুলোরও বেশিরভাগের উৎস বগুড়ার এসব গ্রাম। তা ছাড়া সারাদেশের নামী-দামী চায়নিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে সরাসরি সরবরাহ করা হচ্ছে এখান থেকে। এসব রেস্টুরেন্টে সবজির জোগান আগে আসত বিদেশ থেকে। এভাবে চাষ বাড়তে থাকলে শিগগিরই এসব সবজি বিদেশেও রফতানি হবে বলে আশাবাদী কৃষকরা। বিদেশী সবজি চাষের কারণে সাভারের চায়না গ্রামের উদ্যোক্তারা লাভের মুখ দেখলেও, করোনা মহামারী ও দফায় দফায় বন্যায় ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েছে তাদের। ক্যাপসিক্যাম, বেবিকর্ণ, লেটুসপাতা কিংবা ব্রুকলি, যা ফাস্টফুড ও চাইনিজ রেস্টুরেন্টের খাবার তৈরির অন্যতম উপাদান। দেশে চাইনিজ খাবারের জনপ্রিয়তায় চাহিদা বাড়তে থাকে এসব সবজির। তাই আমদানিনির্ভরতা কমাতে সাভারের মেইটকা ও ভাকুর্তা ইউনিয়নের কৃষকরা করছেন বিদেশী সবজি চাষ। বিশ বছর আগে যার হাত ধরে শুরু এই বিদেশী জাতের সবজি চাষ। সেই কোব্বাদ আলী এখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করোনায় ও গত বন্যায়। কিন্তু এই ক্ষতি কাটাতে যখন নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন, ঠিক তখনই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সব হারানোর শঙ্কায় এ গ্রামের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। দেড় কোটি বসতভিটায় বছরে প্রায় ৫৫ লাখ টন সবজি উৎপাদন সম্ভব সবজি চাষ এখন লাভজনক ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। স্বনির্ভরতা করছে এসব তরুণরা। তাদের প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ। পাশাপাশি আরও অনেকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে। তাই শিক্ষিত যুব সমাজ এখন বেশি মনোযোগী হচ্ছে কৃষিভিত্তিক এই লাভজনক প্রকল্পে। ফলে বাড়ছে গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক তৎপরতা। বর্তমানে দেশে বার্ষিক মোট সবজি উৎপাদন হয় ২২ লাখ টন, যেখানে ১৯৭০ সালে উৎপাদন হতো মাত্র ৭ লাখ টন। তিন দশকে দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে তিনগুণের বেশি।
×