ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভবনের অনুমোদন নিতে ১১ প্রতিষ্ঠানে তদবির

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮

ভবনের অনুমোদন নিতে ১১ প্রতিষ্ঠানে তদবির

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ভবন নির্মাণ অনুমোদনের জন্য ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয় আবাসন শিল্পে জড়িত ব্যবসায়ীদের। একটি ভবনের অনুমোদনের জন্য তাদের যেতে হয় অন্তত ১১টি প্রতিষ্ঠানে। ফলে হয়রানির পাশাপাশি দুর্নীতির শিকারও হতে হয় তাদের, যা রীতিমতো এই ব্যবসার জন্য প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, আবাসন হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এই আবাসন সঙ্কট সমাধানে সরকারের পাশাপাশি তারাও ভূমিকা রেখে আসছেন। রাজধানীসহ সারাদেশে ইতোমধ্যে বেসরকারী আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। একইসঙ্গে তারা লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে চলেছে। কিন্তু একটি ভবন বা প্লট নির্মাণের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ করতে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রচলিত আইন অনুযায়ী একটি বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি পাওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের কমপক্ষে ১১টি দফতরে ঘুরতে হয়। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াদৌড়ির পাশাপাশি ঘুষ আর হয়রানি তো আছেই। এর ফলে একদিকে যেমন ফ্ল্যাট বা প্লটের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়, অন্যদিকে সময়ক্ষেপণের কারণে তৈরি হয় নানা জটিলতা। তবে আশার বিষয়, ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অনিয়ম ও দুর্ভোগ লাঘবে বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে সরকার। সব সেবা একসঙ্গে পেতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস, ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানকে (ড্যাব) বাস্তবায়নযোগ্য করে সংশোধন, বেসরকারী আবাসন প্রকল্প উন্নয়ন বিধিমালা সংশোধন ও আবাসন খাতকে শিল্প হিসেবে ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, বেসরকারী আবাসন সৃষ্টি না হলে সরকারের একার পক্ষে এ বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো না। কিন্তু এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের প্ল্যান পাস করাতে অনেক কষ্ট করতে হয়। এজন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ হলে হয়রানি বন্ধ হবে। আর ড্যাবের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য রিভিউ কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করছি, আবাসন ব্যবসায়ীদের আর কোন সমস্যা থাকবে না। বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন বলেন, দেশের আবাসন সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে, ওয়ান স্টপ সার্ভিস, বাস্তবতার আলোকে ডিটেইল এরিয়া প্লান-ড্যাপ সংশোধন, বেসরকারী আবাসন বিধিমালা সংশোধন ও আবাসনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণার প্রক্রিয়াগুলোর গতি আশানুরূপ হচ্ছে না। তবে বর্তমান গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ব্যবসায়ীবান্ধব হওয়ায় আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত তিনি এসব বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।’ বেসরকারী আবাসন কোম্পানিগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত জটিলতা দূর করা। একটি ভবন নির্মাণের জন্য ১১টি দফতর ঘুরলে একদিকে যেমন সময়ক্ষেপণ হয়, অন্যদিকে নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। আবার কখনও ভূমি মালিকদের সঙ্গে এ নিয়ে মামলায় জড়াতে হয় সংশ্লিষ্টদের। এমনটাই দাবি আবাসন ব্যবসায়ীদের। বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান টিএম এসেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার তানভীর উদ্দিন রাজিব বলেন, একটি বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২টি দফতরে ঘুরতে হয়। একটি ফাইল অনুমোদনের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ১০-১৫টি দফতরে ঘুরতে হয়। এটা আমাদের জন্য খুবই বিরক্তিকর। টাকা ছাড়া কোন দফতরই কাজ করে না। ফাইল অনুমোদন করতে দুই থেকে তিন বছর পেরিয়ে যায়। ওয়ান স্টপ সার্ভিস হলে আমাদের ভোগান্তি কমে আসত। নক্সা অনুমোদনের জন্য যেসব দফতরের অনুমোদন লাগে সেগুলো হচ্ছে- রাজউক, ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, ট্রাফিক বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, পরিবেশ অধিদফতর, সিভিল এভিয়েশন ও বিদ্যুত বিভাগ। আর বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র গ্রহণের পর প্ল্যান জমা দিয়ে তা সভায় উত্থাপন করতেই লেগে যায় দেড় থেকে দুই বছর। এরপর প্রকল্পের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে থাকে। আবাসন ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ওয়ার্ড কমিশনার ও নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কোন অনুমতির প্রয়োজন নেই। আবার বিভিন্ন এলাকায় ভবনের উচ্চতার ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে, তারও কোন টেকনিক্যাল যুক্তি নেই। কখনও কখনও নগরীর জলাবদ্ধতার জন্য আবাসন ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিভাবে দায়ী করা হয়। কিন্তু জলাবদ্ধতা মূলত নগরীর আকার বৃদ্ধি ও উপযুক্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার জন্যই হয়ে থাকে। ব্যবসায়ীরা জানান, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে ফ্ল্যাটের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার জন্য দায়ী। কেবল রডের দাম ১০ শতাংশ কমলে ফ্ল্যাটের দাম বর্গফুট প্রতি ৩০ থেকে ৩৯ টাকা কমে যাবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যাক্স দিয়ে অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার সুযোগ না দেয়ায় শিল্প, উন্নয়ন, উৎপাদন ও ট্রেড খাতে বিনিয়োগ আসছে না। এটাকেও সহজ করে দিতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুত, গ্যাস ও পানির অনুমোদন ও সংযোগে দীর্ঘ সূত্রতার জটিলতা কমানো খুবই জরুরী। তা না-হলে ফ্ল্যাট বিক্রি ও হস্তান্তর অনেক সময় পিছিয়ে পড়ে। সার্বিক দিক বিবোচনা করে আবাসন ব্যবসায়ীদের শুধু ঋণ দেয়াই নয় বরং এজন্য আলাদা একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাও জরুরী। এদিকে ভবন নির্মাণের নক্সা অনুমোদনের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালুর ঘোষণা দিয়েছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেছেন, গৃহায়ণ শিল্পের সমস্যার সমাধানে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করা হবে। এ জন্য একটি সাব-কমিটি কাজ করছে। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু সেই কমিটির প্রতিবেদন আজও আলোর মুখ দেখেনি। মন্ত্রীর এমন ঘোষণার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) তার ৪৫ দিনের সেবা ২০ দিনের মধ্যে করার ঘোষণা দিয়েছিল। এজন্য একটি ডেস্কও গঠন করা হয়। কিন্তু উদ্যোগটি শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে। সেখানে ফিরে এসেছে পুরনো চিত্র। ভবন নির্মাণে এসব জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে ব্যবসায়ীরা ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালুর দাবি জানান। তারা মনে করেন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হলে তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না। ১০ থেকে ১১টি সংস্থার সেবা একই ডেস্কে পাওয়া যাবে। রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল বলেন, এটি এমন একটি সেক্টর মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র সামান্যতম বাকি থাকলেও কাজ শুরু করা যায় না। এরপর সব ধরনের কাজ শেষ করে নক্সা অনুমোদনের জন্য দফতরে দফতরে ঘুরতে ঘুরতে বছরের পর বছর চলে যায়। এরপরও অনুমোদন পাওয়া যায় না। সেই সঙ্গে ১০ তলার বেশি ভবনের অনুমোদনের জন্য অনেক সংস্থার কাছে যেতে হয়। এটা খুবই দুর্ভোগের বিষয়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, একই সড়কে একটি ভবনের অনুমোদন দিলে ওই সড়কেই আরেকটি ভবনের অনুমোদন দিতে অসুবিধা কী? একটি রাস্তার মাপ অনুযায়ী একটি ভবনের অনুমোদন দিলে, পাশের ভবনের জন্য কেন আবার ১২টি জায়গায় যেতে হবে। এই সমস্যা দূর হলে ফ্ল্যাটের দাম আরও অনেক কমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি। রাজউকের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, আমরাও চাই সব কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। আবাসন ব্যবসায়ীরা আমাদের সহায়ক। আমরা চেষ্টাও করছি, কিন্তু সরকারী সিস্টেম এমনই। সে ক্ষেত্রে তো অনুমোদন পাওয়ার জন্য সব দফতরে যেতেই হবে। এ বিষয়ে রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, এমন দাবির পক্ষে সভা-সেমিনার করতে করতে আমরা এখন ক্লান্ত। ভবন নির্মাণে অনাপত্তিপত্রের জন্য বিভিন্ন দফতরে দফতরে ঘুরতে ঘুরতে বছর পার হয়ে যায়। এই সেবাটির জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালুর কথা বলা হলেও তা এখনও কার্যকর হয়নি। এর মধ্যে আবার সিটি কর্পোরেশন তাদের নতুন একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ১০ তলার ওপরে হলে তাদের থেকেও অনাপত্তিপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে আমাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়বে। ভোগান্তি আরও বাড়বে। আশা করি, আবাসন খাতের কথা চিন্তা করে সরকার সমস্যাগুলো সমাধান করবে।
×