ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সম্ভাবনাময় পাটশিল্প

জলি রহমান

প্রকাশিত: ০০:৩৪, ১০ মার্চ ২০২৪

সম্ভাবনাময় পাটশিল্প

পাটশিল্প বাংলাদেশের একক বৃহত্তম শিল্প

পাটশিল্প বাংলাদেশের একক বৃহত্তম শিল্প। বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে চাহিদার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ কাঁচাপাট এবং ৬০ ভাগ পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে অর্জন করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশে ৮৫ থেকে ৯০ লাখ বেল কাঁচাপাট উৎপন্ন হয়। পাট খাতের বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের ৭২ শতাংশ এখন বাংলাদেশের দখলে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে। এর মধ্যে কাঁচাপাট রপ্তানি থেকে এসেছে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৮০ হাজার ডলার

দেশের সোনালি আঁশ নামে পরিচিত পাট, যা একসময়ে ছিল দেশের রপ্তানি আয় অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত। আশির দশকে বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে পাটের অগ্রযাত্রা হয় ব্যাহত। নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এটি আবার ফিরে আসছে  পুরনো ঐতিহ্যে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়। তাই পরিবেশ রক্ষায় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার।

পলিথিনের বিকল্প হিসেবে  প্রকৃতিবান্ধব সোনালি ব্যাগ, পাট হতে স্বাস্থ্যসম্মত পানীয়, জুট-জিও-টেক্সটাইল (সয়েল সেভার) ও বহুমুখী পাটপণ্য উদ্ভাবনের ফলে দেশে ও বিদেশের বাজারেও সৃষ্টি হয়েছে পাটের ব্যাপক চাহিদা। ২০১৬ সালে ৬ মার্চকে ‘জাতীয় পাট দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পাট শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা বেগবান করতে ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার দেশ, স্মার্ট পাট শিল্পের বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে ৬ মার্চ ২০২৪ দেশজুড়ে পালিত হয়েছে ‘জাতীয় পাট দিবস’। বিশেষ অবদান রাখার জন্য এ বছর পাট দিবসে ১১টি ক্যাটাগরিতে ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দেওয়া হয়।

পাটশিল্প বাংলাদেশের একক বৃহত্তম শিল্প।  বিশ্ববাজারে চাহিদার শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ কাঁচাপাট এবং ৬০ ভাগ পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ অর্জন করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশে ৮৫ থেকে ৯০ লাখ বেল কাঁচাপাট উৎপন্ন হয়। পাট খাতের বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের ৭২ শতাংশ এখন বাংলাদেশের দখলে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার আয় হয়েছে।

এর মধ্যে কাঁচাপাট রপ্তানি থেকে এসেছে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এছাড়াও দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে কেবল পাটজাত ব্যাগের চাহিদা ১০ কোটি থেকে ৭০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে এবং অন্যান্য পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৭১৭ কোটি টাকার।
পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য গৃহীত হয়েছে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ।  পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত কল্পে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০’ প্রণীত হয়েছে। এসএমই শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অধিকংশের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল হলো পাট। এটি খুব সহজলভ্য এবং অধিক উৎপাদনশীল।

তাই সহজেই পাট পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে উদ্যোক্তরা হতে পারে স্বনির্ভর। পাট ও পাটজাত বর্জ্যরে সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব বিশেষ সোনালি ব্যাগ, পাটের তৈরি জিন্স (ডেনিম), পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি বিশেষ সুতা (ভেসিকল), পাট কাটিংস ও নি¤œমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত জুট জিওটেক্সটাইল, পাটখড়ি হতে উৎপাদিত ছাপাখানার বিশেষ কালি (চারকোল) ও পাট পাতা থেকে উৎপাদিত ভেষজ পানীয় দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

পাট দিয়ে তৈরি শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, জুতা, স্যান্ডেল, দড়ি,  দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গহনা ও গহনার বক্সসহ ২৩৫ রকমের আকর্ষণীয় ও মূল্যবান পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে।    
এ দেশের ভূপ্রকৃতি ও মাটি পাট উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের তৈরি পণ্যের বিকল্প হিসেবে পাট ব্যবহার করলে একদিকে পরিবেশ, অন্যদিকে পাটকলগুলো রক্ষা পাবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাট চাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এর আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। পণ্য বৈচিত্র্যকরণে সরকারি পাটকলগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করার পাশাপাশি উৎপাদন স্থিতিশীল রাখতে পাটের ন্যূনতম বাজারমূল্য নির্ধারণ করা দরকার। দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট খাতের ওপর নির্ভরশীল। পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয়, এটা পরিবেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকেও রক্ষা করে।

জলবায়ু আন্দোলনের অংশ হিসেবে পানি, মাটি ও বায়ু দূষণকারী পলিব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র জনমত তৈরি হয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৯ সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ’ হিসেবে ঘোষিত ও পালিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর ব্যবহার আরও বাড়ে। তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসেবে শুধু ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এসব ক্ষতি বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার ফলে পচনশীল ও নবায়নযোগ্য দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে।

সাম্প্রতিক ইতালি, ভুটান, চীন, ব্রাজিল, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, কেনিয়া,  তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশী অন্যান্য উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করছে পাটের জীবনরহস্য। বহির্বিশ্বেও সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তাই এ দেশে পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা মোটেও কঠিন নয়।

মানসম্মত পাট উৎপাদন ও পণ্য বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বদেশী পাটপণ্যের কার্যকর ব্রান্ডিংয়ের উদ্যোগ দরকার। একইসঙ্গে রপ্তানির ক্ষেত্রে আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গ্রিন ইকোনমি ও সবুজ পৃথিবীর বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্বে বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগ ও ৩২ মিলিয়ন ফুড গ্রেড পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এর ১০ শতাংশ বাজার দখল করতে পারলে বছরে আয় করা সম্ভব ৫০ হাজার কোটি টাকা।

×