ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোজার সেকাল একাল

 সালমা আহমেদ

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২৪ মার্চ ২০২৪

রোজার সেকাল একাল

.

রমজান মাসটা যেন ছেলেবেলাকে মনে করিয়ে দেয়। রোজা শুরু হলেই একটা ঘোরের মধ্যে আটকে যাই। ছোট্টবেলাটা সারাক্ষণ চারপাশে পাখির মতো কিচির মিচির করতে থাকে। রোজা আসার আগে থেকেই বন্ধু-বান্ধবদের কত পরিকল্পনা- কে কয়টা রোজা রাখব, তারাবি পড়ব, পবিত্র কুরআন খতম করব। সেই মতে চলত প্রস্তুতি। চলত রোজা রাখার নীরব প্রতিযোগিতা। আহা, কি সুখের ছিল দিনগুলো! সবার বাসায় তখন ফ্রিজ ছিল না। বাজারে ভুষি মাখানো বরফ বিক্রি হতো। শেষ বেলায় শুরু হতো হাঁকডাক-এই বরফ বরফ।

এখনো কানে বাজে সেই সুর। সেই বরফ কিনে এনে ধুয়ে পানির জগে রাখা হতো। অপেক্ষায় থাকতাম যেন আজানের সময় কয়েক টুকরা বরফ জগে থাকে। সেটা মুড়মুড় করে খাওয়া যাবে। এখন ছোটরা এসব শুনে হাসে। ওদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। পরিবার প্রতিবেশীদের রোজা রাখা দেখে ছোটরাও তখন রোজা রাখতে চেষ্টা করত। ভোরে উঠতাম সেহরি খেতে। অর্ধেক বেলা শেষ হতেই ক্লান্তি ভর করত। বলতাম, মা গলা শুকিয়ে গেছে। মা বলতেন, এই তো আর একটু। এইআর একটুতো আর শেষ হয় না। বেশি নেতিয়ে পড়লে মা বলতেন, সারাদিন এত কষ্ট করে রোজা রেখে শেষ বেলায় এসে ভেঙে ফেলবে? তখন ভাবতাম, তাই তো। সময় তো আর শেষ হয় না। এখন স্কুল খোলা থাকে বলে বাবা-মায়েরা সেভাবে ছোটদের রোজা রাখতে উৎসাহিত করে না। আমাদের সময় পুরো রোজার মাস স্কুল বন্ধ থাকত। দুপুর হলেই মা বলতেন, এখন খেয়ে নাও। তোমার একটা রোজা হয়ে গেছে। কখনো বলতেন, কলসির মধ্যে ফুঁ দিয়ে রোজাটা রেখে খেয়ে নাও। খাওয়া শেষে আবার নিয়ে নিও। তা হলে রোজা ভাঙবে না। এভাবে চলত বাবা-মায়ের রোজা ভাঙানোর চেষ্টা। বেশি খুশি লাগত যেদিন মসজিদে, প্রতিবেশীদের ইফতার দেওয়া হতো। সেদিন বাসায় অনেক আইটেম হতো।

বাড়ির বড়রা রমজান মাসকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। শবেবরাতের পর থেকেই সব কিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রোজার জন্য প্রস্তুতি নিতেন। গ্রামে নতুন মাটি দিয়ে ঘর লেপা হতো। রমজানে রাতের জন্য রান্না হতো এবং সঙ্গে ইফতারের আয়োজন। রোজার সকালে ঘুম ভাঙত মায়ের পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত শুনে। আসরের আগে রান্না শুরু হতো। সব কাজ শেষ করে মায়েরা এসে হাসিমুখে বসতেন ইফতার করতে। ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে সবাই গোল হয়ে ইফতার নিয়ে বসতো। বাবা বলতেন, ‘এখন মনে মনে দোয়া কর। দোয়া কবুলের এটা উত্তম সময় বাবা মোনাজাত করতেন, আমরাও অংশ নিতাম। আজান পড়লে সবাই ইফতার শুরু করতাম। খাবার সামনে নিয়ে ১৫/২০ মিনিট নিজেকে সংযত রেখে অপেক্ষা করা ছোট বয়সে কঠিন একটা ব্যাপার! তারাবির নামাজ পড়তে কাগজ-কলম নিয়ে বসতাম। দুই রাকাত পড়ে লিখে রাখতাম, যাতে ভুলে না যাই।

ইফতারের আগ মুহূর্তে সাইরেন বাজত। তখন খুব খুশি লাগত। ইদানীং সেই সাইরেন আর শোনা যায় না। ভোরে এলাকার ছেলেরা দলবদ্ধ হয়ে ডেকে তুলত সবাইকে- ‘উঠুন, সেহরি খাওয়ার সময় হয়েছে। সেহরি খেয়ে নিন। আর বেশি সময় নেই।সেই সুর এখনো যেন কানে বাজে। তবে এখন আর সেই ডাক শোনা যায় না। এখনকার দিনের ছেলেমেয়েরা এসব শুনে অবাক হয়। আমাদের সময় সেটাও ছিল একটা আনন্দের বিষয়। প্রত্যেক পাড়া থেকে কয়েকজন মুরব্বি এতেকাফে বসতেন। আমার বাবা বসতেন প্রতি বছরই পাশের মসজিদে। দুপুরের পর প্রায়ই মসজিদে গিয়ে বাবার সঙ্গে বসে থাকতাম। আর রোজা রাখলে তো কথাই নেই।

সে সময় লোকসংখ্যা কম থাকায় এলাকার মানুষ নিকটাত্মীয়ের মতো থাকত। ফলে সবাই সবার সামাজিক আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানত, খোঁজও রাখত। মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা ছিল। ফলে প্রতিদিন নিজ পরিবারের সাথে প্রতিবেশীর জন্যও ইফতার বরাদ্দ থাকত। সেহরিতে একে অন্যকে ডেকে দিত। এখন আমরা আমাদের পাশের ঘরে কে থাকে তাই জানি না। সেহরিতে উঠতে পারল কিনা তা নিয়েও মাথা ঘামাই না। সবাই এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি যে, কেউ কারও খোঁজ করি না। বেশিরভাগ ঘরের মায়েরা চাকরিজীবী হওয়ায় এখন রোজায় সেই প্রাণচাঞ্চল্যও নেই। নেই ইফতার বা রাতের খাবার তৈরির সেই আয়োজন। আগের মতো তেমন ইফতারও বিলি-বণ্টন হয় না। সব কিছুতেই কৃত্রিমতার ছোঁয়া। কিছুটা হলেও আমাদের নতুন প্রজন্মকে এই শিক্ষাটা না দিলে ভবিষ্যতে পরিবার থেকেও সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই এখনই সময় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার।

বাবা-মা, ভাই-বোন মিলে ইফতার তৈরি করা, খাওয়া-এই আনন্দ সারাদিন রোজা রাখার ক্লান্তি দূর করে দেয়। রমজান মাসটা একটা উৎসবে পরিণত হয়। পুরনো দিন আর ফিরে আসবে না জানি। কিন্তু পরিবার আর প্রতিবেশীদের সেই বন্ধন অটুট থাকুক।

×