ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

নিখোঁজ রহস্যের সমাধান কোন্্ পথে

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৮ জানুয়ারি ২০২২

নিখোঁজ রহস্যের সমাধান কোন্্ পথে

নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়টি এবার বেশ জোরেশোরে আলোচনায় এসেছে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বরের পর। মূলত ওই বছরের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস থেকে। ওই দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স হিসেবে খ্যাত র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং সংস্থাটির বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দেশেও মানবাধিকার দিবসে গুম বা নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির পরিবারবর্গ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে। এর পর থেকেই কমবেশি নানাভাবে আলোচিত হতে থাকে গুম বা নিখোঁজের বিষয়টি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গত ১৩ জানুয়ারির একটি বিবৃতির পর বিষয়টি সংবাদপত্রের ভাষায় আবার একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পুলিশ ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছ থেকে বক্তব্য সংগ্রহ করছে। যেখানে বলা হচ্ছে ভুক্তভোগীরা কোথাও লুকিয়ে আছেন। এটি বেআইনী এবং অনাকাক্সিক্ষত।’ এই বিবৃতি প্রকাশের পরদিন অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে পাল্টা বিবৃতি দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘প্রতিবেদনে অতিরঞ্জিত এবং বিকৃত সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।’ পুলিশের ভাষ্য, ‘বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ‘গুম হওয়া’ সংক্রান্তে দায়েরকৃত অভিযোগের বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন এবং উপস্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভিকটিম এবং অভিযোগ প্রদানকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, তাদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করা পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রথাগত দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে পুলিশ মাঝে মধ্যে ভিকটিমের পরিবার কিংবা অভিযোগকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিকটিমের পরিবার বা অভিযোগকারী ব্যক্তিবর্গ পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে থাকেন।’ কী বলছে মায়ের ডাক : ঢাকা মহানগর পুলিশের ওই বিবৃতির পরই ঘটনা থেমে থাকেনি। পরদিন ১৫ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন এক সংবাদ সম্মেলন করে। সেই সংবাদ সম্মেলনেই মূলত বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতির ব্যাপারে গুম হওয়া ব্যক্তিদের মা, স্ত্রী এবং বোনেরা ‘হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে’ দেন হঠাৎ করে পুলিশের অতি তৎপরতা নিয়ে। সংবাদ সম্মেলনে ‘গুম’ বা নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বাড়ি গিয়ে ‘পুলিশী হয়রানির’ অভিযোগ করা হয়। অভিযোগের একটি হলো, সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসান সুজনকে ২০১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার আর খোঁজ মেলেনি বলে তার পরিবারের অভিযোগ। সুজনের ভাই জাহিদ খান শাকিল শনিবার মায়ের ডাক অনুষ্ঠানে বলেন, গত ১০ জানুয়ারি পুলিশ তাদের বাসায় গিয়ে ‘দায়সারা একটি জবানবন্দীতে’ স্বাক্ষর করার জন্য চাপাচাপি করে। তার বাবার সঙ্গে পরিবারের সবার সামনে করে ‘রূঢ় আচরণ’। একই বছর ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তিতুমীর কলেজের ফাইন্যান্স বিভাগের ছাত্র আবদুল কাদের মাসুমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘ধরে নিয়ে’ যাওয়ার পর তারও আর খোঁজ মেলেনি। মাসুমের বোন আয়েশা আক্তার বলেন, ‘গত ৫ থেকে ১৩ জানুয়ারির মধ্যে পুলিশ তিনবার তার বাড়িতে গেছে। ছবি দেন, হিস্ট্রি দেন, এটা বলে-ওটা বলে। কেন এরকম হয়রানি করছে? মাসুম গুম হওয়ার পরে তো প্রশাসনের সব দরজায় আমরা গেছি। তখন তো আমাদের কাউন্টই করেনি। আজকে কোন উদ্দেশ্যে এরকম করছে? আমাদের সন্তান খুঁজে বের করার দায়িত্ব ছিল আপনাদের, হয়রানি করা নয়। আপনারাও তো মানুষ।’ কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন ২০১৯ সালের ১৯ জুন দোকান থেকে খাবার খেতে বেরিয়ে আর ফেরেননি। তিনিও ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার’ বলে পরিবারের বিশ্বাস। সংবাদ সম্মেলনে ইসমাঈলের স্ত্রী নাসিমা আক্তার তার দুর্বিষহ জীবনের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। নাসিমা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, র‌্যাব, পুলিশ হেডকোয়ার্টার, মানবাধিকার- তিনটা বছর আমি সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। আমি থানায় গেছি, পুলিশ আমাকে বের করে দিয়েছে। তিন বছর পর পুলিশ আইসা জিজ্ঞেস করে, আমার স্বামী গুম হয়েছে, নাকি কোথাও চলে গেছে? হাস্যকর এগুলো।’ বংশাল থানা ছাত্রদলের নিখোঁজ সভাপতি পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, ‘পুলিশ বাসায় গিয়ে আমার শাশুড়ির কাছে জানতে চেয়েছে তার ছেলে কোথায়। তারপর আমাকে ফোন করে বলে, ‘আপনার হাজবেন্ড কই’। নিখোঁজ যুবদল নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বড় বোন, মায়ের ডাকের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম বলেন, ‘আমরা আমাদের স্বার্থেই পুলিশকে সহযোগিতা করব। কিন্তু আপনারা এই যে হাফ উইডোদের (প্রায় বিধবা) কখনো দিনে কখনও রাতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। দুই ঘণ্টা আটকে রেখেছেন। তারা ভীতির মধ্যে আছেন। যা করতে হয়, মানবিকতার সঙ্গে করেন। আমরা একটা নিরপেক্ষ, বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। আমরা চাই জাতিসংঘের তদন্ত কমিটিকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হোক। এটার একটা সুষ্ঠু তদন্ত হোক।’ ২০১৩ সালে নাখালপাড়া থেকে অন্তর্ধান হন আবদুল কাদের ভুঁইয়া মাসুম। মাসুমের মা আয়েশা আলি জানান, তার কাছে ৩ বার পুলিশ এসেছে। গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার, রবিবার এবং সর্বশেষ বৃহস্পতিবার। আয়েশা বলেন, ‘আমি জিডিতে ‘সে হারিয়ে গেছে’ লিখতে বাধ্য হই।’ একই দিন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট সুলতানা কামাল অপর এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সরকারী বিভিন্ন সংস্থা গুমের শিকার হওয়া ভীতসন্ত্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে গিয়ে কিংবা তাদের থানায় নিয়ে এসে সাদা কাগজে জোর করে স্বাক্ষর নেয়াসহ বিভিন্নভাবে যে হয়রানিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। গুমের শিকার পরিবারগুলোর ন্যায়বিচার না পাওয়ার ক্রমবর্মান অবক্ষয়ের যে চিত্র প্রতিদিন উঠে আসছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং গুমের শিকার পরিবারগুলোর প্রতি তা চরম নিষ্ঠুরতা।’ নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জোর দাবি জানান তিনি। এসব ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয়, কিছু পরিবারকে হয়রানির পাশাপাশি তাদের জোর করে লিখিত বিবৃতিতে সই করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এসব মুচলেকায় বলা হয়েছে, ‘স্বাক্ষরকারী ইচ্ছাপূর্বক তথ্য গোপন করে পুলিশকে ভুল পথে পরিচালিত করেছেন।’ মায়ের ডাক এর প্রধান সাঞ্জিদা তুলির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ ধরনের কমপক্ষে ১০টি পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছে পুলিশ। প্রশ্ন হলো, পুলিশ এতদিন পর গুম বা নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে এত তৎপর হলো কেন? মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসেছে আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি আলোচনায় আসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ গ্রহণের পর। (আগামীকাল সমাপ্য) ২৬.০১.২২ লেখক : সাংবাদিক
×