ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সহকর্মীকে যৌন হয়রানির শাস্তি, দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি বন্ধ

প্রকাশিত: ১৭:২৭, ৪ মে ২০২৪

সহকর্মীকে যৌন হয়রানির শাস্তি, দুই বছরের জন্য বেতন বৃদ্ধি বন্ধ

ডা. রাফিউল হাসানের বেতন বৃদ্ধি আগামী দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসককে যৌন হয়রানির অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও গবেষণা বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. রাফিউল হাসানের বেতন বৃদ্ধি আগামী দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ডা. রাফিউল বর্তমানে বরগুনা পাথরঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত। সম্প্রতি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

জানা গেছে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত এক নারী চিকিৎসক যৌন হয়রানির প্রতিকার চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেন। অভিযোগ পাওয়ার পর ডা. রাফিউল হাসানকে বরগুনার পাথরঘাটায় বদলি করা হয় এবং একটি বিভাগীয় মামলা হয়। একই সঙ্গে অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে অধিদপ্তর। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় ডা. রাফিউলের বেতন বৃদ্ধি আগামী বছর স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর গত ৪ মার্চ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে সরকারি চাকরি বিধিমালা ২০১৮-এর বিধি ৪(২) খ অনুযায়ী আগামী দুই বছরের জন্য বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি লঘুদণ্ড আরোপ করে বিভাগীয় মামলাটি নিষ্পত্তি করে। একই সঙ্গে তার সাময়িক বরখাস্তের প্রজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করা হয়।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. রাফিউল হাসান গণমাধ্যমকে জানান, তিনি এ ধরনের কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত নন। তিনি একজন নারী চিকিৎসক সহায়তা করেছেন। ওই নারী চিকিৎসক সহায়তা করার জন্য ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পরে ওই নারী চিকিৎসককে দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে অভিযোগটি করিয়েছেন। অভিযোগটি তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। তিনি দায়িত্ব পালনকালে অন্যদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন এমন অভিযোগে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি এ শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানান।

নারী চিকিৎসক লিখিত অভিযোগে জানান, কর্মস্থলে অনুপস্থিতিজনিত কারণে ব্যক্তিগত শুনানি প্রদানের জন্য ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ডাকা হয়। এরপর তিনি একজন সিনিয়র চিকিৎসকের মাধ্যমে জানতে পারেন অধিদপ্তরের ডা. রাফিউল হাসান এসব বিষয়ে ভালো জানেন এবং তার কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া যায়। এরপর তিনি ব্যক্তিগত শুনানির কার্যক্রম সম্পর্কে জানার জন্য ডা. রাফিউলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। রাফিউল তাকে ২৪ আগস্ট সশরীরে তার অফিসে (পরিকল্পনা ও গবেষণা) দেখা করতে বলেন এবং এ বিষয়ে সামান্য দেরি করলে ওই নারীর বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে বলে ভয় দেখান।

অভিযোগে নারী চিকিৎসক জানান, রাফিউলের কথা অনুসারে তিনি ওইদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তার সঙ্গে দেখা করতে যান। এ সময় তিনি ব্যক্তিগত শুনানির ব্যাপারে নানারকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন। তাকে মানসিকভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন। চাকরি বাঁচাতে চাইলে তিনি যা বলবেন সেভাবেই চলতে হবে বলে জানান। এ ব্যাপারে একমাত্র রাফিউলই তাকে সাহায্য করতে পারবেন, তার কথা না শুনলে বড় বিপদ হবে এসব বলে ভয় দেখান। মহাপরিচালকের সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তার মধ্যে তিনি (রাফিউল) একজন বলেও ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা করেন।

ওই নারী আরও উল্লেখ করেন, নানা কাজে ব্যস্ততা দেখান ডা. রাফিউল। কাজ শেষে তাকে সময় দেবেন বা সাহায্য করবেন বলে ওইদিন সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তার অফিসে বসিয়ে রাখেন। ৭টার পর কোনোরকম সাহায্য বা দিকনির্দেশনা দেওয়া ছাড়াই ওই নারীকে পরদিন ২৫ আগস্ট সকাল ৯টার আগে অফিসে দেখা করতে বলেন। এ সময় সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে ডা. রাফিউল তার পিঠে ও ঘাড়ে হাত রাখেন। এতে অস্বস্তি বোধ করেন নারী চিকিৎসক। দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে যান তিনি। এ সময় ডা. রাফিউলও তার সঙ্গে সঙ্গেই অফিস থেকে বের হন।

ভুক্তভোগী আরও জানান, পরদিন রাফিউলের কথামতো অফিস শুরুর আগে উপস্থিত না হয়ে ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে তার অফিসে যান। এ সময় অফিসে ডা. রাফিউল ছাড়া কেউ ছিল না। ভুক্তভোগী নারী চিকিৎসক কেন দেরি করে এসেছেন এজন্য বিরক্তি ভাব প্রকাশ করেন। এ ছাড়া নানা ধরনের অপমানজনক কথা বলতে থাকেন। দেরি করে আসায় এখন সাহায্য করতে পারবেন না বলে জানান। বিপদে পড়তে না চাইলে আবার বিকেলে দেখা করতে বলেন। তার বলা কথায় ভয় পান ভুক্তভোগী। তিনি তার কথা অনুসারে ৪টার দিকে দেখা করতে অফিসে যান। এ সময় অফিসে সবাই ছিলেন। কিন্তু তিনি ৫টা পর্যন্ত বসিয়ে রাখেন। ৫টার পর ধীরে ধীরে অফিসের সবাই একে একে চলে যেতে শুরু করেন।

নারী চিকিৎসক অভিযোগপত্রে আরও বলেন, আমি উনার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসেছিলাম। উনি আমাকে উঠে এসে তার পাশের চেয়ারে বসতে বলেন। আমি এতে অপারগতা প্রকাশ করলে উনি তার চেয়ার থেকে উঠে আমার চেয়ারের পেছনে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন এবং শরীরের স্পর্শকাতর অংশে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমি ছিটকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে উনি আমার হাত চেপে ধরেন। অফিসে তখন অন্য কেউ আছে কি না, বুঝতে পারছিলাম না বলে তার কথায় আরও ভয় পেয়ে চলে যেতে উদ্যত হই। তখন রাফিউল শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে বাধা দেন। একই সঙ্গে নানা ধরনের চরম অবমাননাকর ও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেন। পরবর্তী সময়ে ফোন দিলেও আর কথা বলিনি।

এ ঘটনায় ডা. রাফিউলকে প্রথমে বদলি করা হয়। এরপর ২০২২ সালে ৬ জুন সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গত বছর মার্চে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করা হয়। এক বছর পর তাকে লঘুদণ্ড দিয়ে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

 

এবি

×