সৃষ্টির উন্মাদনায় দুস্তর পথ অতিক্রম করে মানুষ। সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়া গেলে হয়ত কেউই সৃষ্টির কঠোর সাধনায় প্রাণপাত করতেন না। আবার এ কথাও স্বীকার করতে হয়, যাপনের অর্জিত অভিজ্ঞতার তারতম্য জীবনকে দেখার কৌশল বদলে দেয়। জীবন ও জগত সম্পর্কে একজন ব্যক্তি মানুষের অনুভব, উপলব্ধি ও অনুভূতিকে লিখিতভাবে প্রকাশ করাই সৃজনী রচনাকর্মের মূল কথা। নিজের জীবনকে এবং সেই জীবনের পরিপার্শ্ব ছুঁয়ে, কবি জগতটাকে কী চোখে দেখছেন-সেটাই কবিতায় বলবার বিষয়। জীবন সম্পর্কে কবির যে দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন সেগুলোই তার কবিতা। এভাবে জীবন পর্যবেক্ষণের নতুনতর কৌশল কবিতাকে ভিন্নচিন্তার সৌরভে জারিত করতে পারে। হাবীবুল্লাহ্ সিরাজীকে এক্ষেত্রে অগ্রগামী হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কেননা, তার কবিতার শব্দমাধুর্যই প্রমাণ করে তিনি ভিন্নভাবে জীবন অবলোকনে পারঙ্গম। কবি হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী সেই কবিতাই লিখেছেন, যা জীবন ও দর্শনের আধার। ফলে, তার কবিতাগুলো হৃদয় ও মস্তিষ্কের সম্মিলিত আকরবিন্দু থেকে উঠে আসা স্বদেশ ও সমকালের নির্যাস হয়ে উঠেছে। জীবনের প্রতিটি স্তরের ব্যতিক্রমী ব্যঞ্জনা হাজির করার পাশাপাশি তিনি জীবনের অনুষঙ্গ রূপায়িত করেন গাণিতিক সমীকরণে। ‘একটি অসম্পূর্ণ ম্যাজিক’ শিরোনামের কবিতায় তিনি বলেন- ‘অন্ধকার না বুঝেই ঝাঁপ দিয়েছিল বিড়াল/ খাদও কিছু সামলানোর না পেয়ে পাতে বুক/ হিসেব না পেয়ে মধ্যবর্তী অংশ হারিয়ে ফেললে সময়/ যে ব্যাপারটি কিংবা বিষয়গুলো প্রস্তুত হয় নতুবা ঘটতে পারে/ তার কোন বর্তমান থাকতে নেই।’ কবিতাটি নির্ভেজাল এক গণিত বললে অত্যুক্তি হয় না। গাণিতিক ফর্মে জীবনের সমীকরণই যেন মেলাতে চেষ্টা করেছেন তিনি! কবিতাটির শেষাংশে তিনি যখন বলেন-
‘বিড়াল শূন্য, খাদ শূন্য, সময় শূন্য, বিষয় শূন্য
আর বর্তমানকে মহাশূন্য ধরে নিলে
আকাক্সক্ষার ভেতর ফুটতে থাকে দানাবীজ
একটি অসম্পূর্ণ ম্যাজিক।’
তখন এই শূন্যতার দর্শন, ভিন্নচিন্তার স্পর্শে উত্থিত অনুভূতিশক্তি তাকে অন্য কবি থেকে পৃথক করে। আবার এটাও ঠিক, হাবীবুল্লাহ্ সিরাজীর কবিতার পঙ্ক্তিমালা এতটাই রহস্যময় যে, অনেক সময় সব পঙ্ক্তির পাঠোদ্ধারও সম্ভব হয় না; তবে ভাল-লাগা আর ভাব-অনুভবের আনন্দস্পর্শ থেকে পাঠক বঞ্চিত হন না। তিনি ‘ভুট্টাক্ষেতে মই দেবেন না’ কবিতায় বলেন-
‘জমাট মাটিতে ঈষ হবো
তুলে নেবো চামড়া, খুলে ফেলবো মাংস, ঢুকে যাবো হাড়ে
আকুল হ’য়ে আছি, বৃষ্টির আগেই উপযোগী হবো
যারা মই দিতে চান, তারা সাবধান!
ডালে ও পাতায় ফড়িং হ’য়ে আছি
ছাল খুলে নেবো, দানা ভেঙে দেবো
লালা মিশিয়ে গোলা হ’লে গিলে ফেলবো
ব্যাকুল হ’য়ে আছি, আগুন লাগার আগে
দয়া করে ভুট্টাক্ষেতে মই দেবেন না!
বীজ তুলে রেখে দেবো ব’লে মাটি খুঁজি গর্ভের আহ্লাদে-
হে তরঙ্গ, আপনি সম্মানিত করুন
আমাদের শস্যমালা বংশ দিয়েছে!
আমি তো পূর্বেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম
দানা তার আশ্রয় ফিরে পাবে
ভুট্টাক্ষেতে কেউ মই দেবেন না।’
কবিতায় তিনি কেবল কতগুলো দৃশ্যই তৈরি করেন না, ভিন্নতর চিন্তার পুণ্যজলে পাঠককে অবগাহনও করান। অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে বলা যায়, সভ্যতার ক্রমোন্নতি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে; মানুষ হয়ে উঠেছে একা। মানুষের একাকিত্বের সুযোগে ঢুকে পড়ছে বিশ্বায়নের ফাঁদ। কবি সিরাজী প্রবল শেকড়সন্ধানী হওয়ায় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন মানুষের এই রূপান্তর। তাই তিনি সতর্ক করে দেন মানুষ যেন শেকড়বিচ্যুত না হয়। কেননা, ‘গর্ভের আহ্লাদে’ যে বীজ তোলা আছে, তা থেকে আগামীর শস্যবৃক্ষ ফলবান হবে। বস্তুত তিনি সেই ফাঁদ বা কুচক্রী মহলকে সাবধান করেন, যারা নানা অপকৌশলে আমাদের শেকড়বিচ্যুত করতে উদ্যত।
হাবীবুল্লাহ্ সিরাজীর কবিতায় প্রয়োগকৃত ভাষা এবং প্রকরণ অভিনব। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপগুলোও শিল্পিত। ছকে বাঁধা কাব্যপথের যাত্রী নন বলেই সিরাজীর কবিতাগুলো আলাদাভাবে চোখে পড়ে। কবির ‘রোদমঞ্জু ছায়াবেলা’ কবিতাটির পাঠ নেয়া যেতে পারে-
‘ছায়া ও পাথরে যুদ্ধ হচ্ছে
ছাদ থেকে দেয়াল তারপর মেঝে আক্রান্ত হ’লে
ছায়া জিজ্ঞেস করে, আরো
পাথর নিশ্চুপ
রোদ বেড়াতে গিয়েছিলো পর্বতে
বরফ বললো, আছি প্রিয়তম
চুম্বনের অগ্রভাগে আমাকে রেখো
রোদ হাসে
পাথর ও বরফের মধ্যে সন্ধি হলে
রোদমঞ্জু ছায়াবেলা হবে’
নান্দনিক শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য জীবনকে দেখবার ও লিখবার বিশিষ্ট একটা ভঙ্গিমা থাকা চাই। ‘জীবনসংশ্লিষ্ট যত রকমের অনুভূতি ও উপলব্ধি থাকা সম্ভব, সে সবের মধ্যে যেগুলো উদ্ভাবনী; সেই উদ্ভাবনীকে যখন উপস্থাপন করা হয় এমন এক ভাষায়, যে ভাষা ওই উদ্ভাবনীটির জন্য অনিবার্য ভাষা; তখনই সৃজিত হয় কবিতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, উপস্থাপিত টেক্সটটি নয়, বরং উপস্থাপিত টেক্সটের ইশারা থেকে অলিখিত এবং অভীষ্ঠ অপর এক বা অসংখ্য টেক্সটে পৌঁছে যাওয়াই কবিতার মূলকথা। ...কবিতা, প্রকৃত প্রস্তাবে, শব্দচিত্রে উপলব্ধির দৃশ্যায়ন।’ এ ক্ষেত্রে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কতটুকু সফল, ‘রোদমঞ্জু ছায়াবেলা’ কবিতা থেকে পাঠ নিলেই তা উপলব্ধিতে আসতে পারে।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার একটি বড় বৈশিষ্ট্য সাধারণ শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে অসাধারণ অভিব্যক্তি প্রকাশ। একেবারে সাদামাটা, অপ্রয়োজনীয় শব্দ তাঁর কবিতায় সগর্বে স্থান লাভ করে। তিনি অকপটে পাথর, ছায়া, বরফ, মেঝে, রোদ, পর্বত ইত্যাদি সাধারণ শব্দ অসামান্য দক্ষতায় উপস্থাপন করেন। তবে তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ সরল হলেও কাব্যভাষা উচ্চতর। উপমা-উৎপ্রেক্ষা, প্রতীক-ইঙ্গিত প্রয়োগ করে কবিতাকে কখনো এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা সাধারণ পাঠে উন্মোচিত হয় না। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবি-প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক ফরিদ আহমদ দুলাল ‘বাংলা কাব্যের স্বতন্ত্র স্বর হাবিবুল্লাহ সিরাজী’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘কবিতা যে অমনোযোগী পাঠের অনুষঙ্গ নয়, কবিতায় অন্তরপ্রবাহ বিদ্যমান; কবিতায় যে গোপন-অদৃশ্য সৌন্দর্য বিদ্যমান; এসব সত্য হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা পাঠে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।’ প্রাবন্ধিকের এ ভাষ্য আত্মস্থ করেই বার বার পাঠের মধ্য দিয়ে হাবিবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে হয়। নন্দনতত্ত্ব বলে, সহজ উপস্থাপন যখন ভাবনাবিভূতির প্রভাবে দীর্ঘস্থায়ী চিন্তনসৌন্দর্যের দার্শনিক অবকাঠামো নির্মাণ করে, তখনই সেটা কবিতা হয়ে ওঠে। শিল্পের এই করণকৌশলেও সিদ্ধহস্ত কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি সরল শব্দসমবায়ে চিন্তন-সৌন্দর্য বিনির্মাণ করেও পাঠককে সৌকর্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। আর এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কবির ‘হৃদয় মেলিয়া কাক দেখিলাম’ কবিতাটির পাঠ নিতে পারি-
অবসর খাকি টুপি জমা দিলে
টুটাফাটা জুতো হা-মুখে তাকায়-
ডুবে থাকা ঘাড়ে ছেঁড়া ফিতে বেঁধে
লগ এলাকায় মামলা নামায়!
ঢিলে চামড়ায় জমে থাকা নুনে
ফাটা আঙ্গুলের দায় শতকণা-
দুই চোখে ঠুলি, তুলো গোঁজা কানে
সোনার ওজনে তামা বনিবনা!
হাঁটুতে বুদ্ধি হোঁচটে লালসা
যা সকল ডান তার সব বাম
লুট করে নিলে শাপলার বিল
হৃদয় মেলিয়া কাক দেখিলাম!
কবিতাটি ইশারাবাহী। তবে কীসের ইশারা দিয়েছেন কবি, তা বুঝতে গেলে চিন্তার কোষে একাধিক বিষয় এসে যুগপৎ ভিড় করে। কবিতায় যা কিছু প্রতীকী, তার মধ্যেই এ কবিতাটির গূঢ়ত্ব নিহিত বলা যায়। তিনি যে প্রতীকী চরিত্র বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করে কবিতাকে সার্থক করে তুলতে সচেষ্ট থাকেন- তাও পাঠকের অন্তর্দৃষ্টি এড়ায় না। প্রেমের কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও তিনি প্রতীক-ইঙ্গিত, আড়ালের আশ্রয় নেন। কবি যখন ‘জাদু ও বাঁশি’ কবিতায় বলেন-
‘উড়ছে বাংলাদেশ।/ সবুজ ও সূর্য উড়তে-উড়তে/ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল হ’য়ে গেলে/ আমার সোনার বাংলা আমারই পতাকা-/ যে পারে সে ধরে/ জাদুকর তাহারে ওড়ায়।/ বাঁশি শুনে কাজ আছে/ সুর হে, বনেরও যে মন পোড়ে/ বায়ু বহে- ফোটে স্নেহলাল/ দিবস-রজনী নিয়ে বাঁশি তাই লিখে রাখে/ মানুষের নাম।/ মোহন আনন্দ মিলে যেই মায়াজাদু/ বাঁশি তার অপার বেদনা।’ তখন, দেশমাতৃকার প্রতি কবির প্রেম ও প্রজ্ঞা প্রকাশিত হয়। এই প্রেম নিবিড় এবং সঘন। স্পর্শ করে যায়, রেখা টেনে যায় পাঠকের মননে; আর সেখানেই কবিতা সার্থকতা লাভ করে। যে কবিতায় মানুষ পায় নিজের খোঁজ, নিজের অস্তিত্ব, সেখানেই তৈরি হয় তার ভাললাগা। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর রয়েছে শব্দচয়নের অপরিসীম দক্ষতা, ছন্দের নিষ্ঠা এবং পরিমিতির নান্দনিক পরিবেশনা। কবির প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’-এর ‘জলপরী’ কবিতা থেকে অংশবিশেষ পাঠ নিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে-
‘চন্দননগর যাবো’- ব’লে গেলো উজান পাহাড়
থেকে উড়ে আসা পাখি; মাথায় উড়াল ঝুঁটি, কালো
চোখে ঘর-জল ভাসে থৈ থৈ... আহা সবুজ নায়রী
নরম পালক তুলে লেখে নাম: চন্দননগর!’
বস্তুত, যেভাবেই পাঠ করা হোক না কেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতাকে সাধারণ মানের কবিতা বলার সুযোগ থাকে না। ভাষার মুন্সিয়ানায় তার কবিতা পাঠকের কাছে স্বতন্ত্র হিসেবেই ধরা পড়বে। কেননা, ‘আমার মিত্র যে স্বপ্নগাত্র খুলেছে সে/ ওলো দাসী, চক্ষু মেলে শাদা পক্ষী ধর-/ শাদা বায়ু, শাদা আয়ু, পক্ষী তো সলক/ অঘোর পক্ষের গর্ভে সৃষ্টির ফলক;/ আমিও যে তার মিত্র-অষ্টযাত্রা কর!’-এভাবেই, অসাধারণ ও নতুনতর উপস্থাপন কৌশলে ষাটের দশকের অন্যতম এই কবি তার কবিতাকে ব্যঞ্জনা দিয়েছেন। বৈষয়িক পারদর্শিতা ও শব্দ নির্বাচন কৌশলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে প্রতীকী ও সত্যাশ্রয়ী। যুগের সত্যকে, মানব সত্যকে, মননের সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেই তিনি হয়ে উঠেছেন ভিন্ন ধারার জীবনশিল্পী।