বিয়ে সমাজের প্রাচীনতম একটি মেলবন্ধন প্রথা। আর এ প্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। এই জন্যই তো বিয়ে নিয়ে জারি করা হয়েছে রীতিনীতি ও ধর্মীয় অনুশাসন। বৈদিক যুগ থেকেই বিয়ে নারী-জীবনের প্রধান প্রাপ্তি ও পরম সার্থকতা বলে বিবেচিত। ইসলাম ধর্মে বিবাহ একটি আইনগত, সামাজিক এবং ধর্মীয় বিধান। ইসলামে বিবাহ বলতে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও ধর্মীয়ভাবে নির্ধারিত একটি চুক্তি বোঝায়। আর খ্রিস্ট ধর্মে বর্ণিত আছে, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ স্বামী-স্ত্রী তারা দুইজন মিলে এক দেহ। আর খ্রিস্ট ধর্মে এক বিবাহের নিয়ম প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্ন ধর্মের বিবাহ বিভন্ন রকমের হলেও আমাদের বাঙালীয়ানা বিবাহগুলোর রীতির মধ্যে এক ধরনের বাঙালীয়ানার সংস্কৃতির আঁচ পাওয়া যায়। এই জন্য আমাদের এক প্রবাদে বলা হয়; যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শীর ঘুম নাই। এই প্রবাদটা কিন্তু এমনি এমনি কথার ছলে হয়নি। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, আগে এমন একটা সময় ছিল, বাংলার গ্রামে গ্রামে কোন বাড়িতে বিয়ের ধুম পড়লে পাড়া-পড়শীর ঘুম থাকত না। বিয়ের আনন্দ-আয়োজনে অংশীদার হতো পুরো গ্রামের বাসিন্দারা। আবার এমনও দেখা যেত কোন বাড়িতে বিয়ে বা বিয়ের খরচ বাঁচানোর জন্য পাড়ার সব বাড়ি থেকে একজন করে আসার কথা বলা হতো। কিন্তু মেয়েদের মধ্যে দাওয়াতের বালাই ছিল না। কনের কাছে মেয়েরা আসত দল বেঁধে। কনেকে সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করতেন তারা। আর বাড়ির ছেলেমেয়েরা লাল-সবুজ-হলুদ রঙিন কাগজের পতাকা কেটে গেট সাজাত। সবাই জানান দিত, এখানে আনন্দযজ্ঞ চলছে। বাড়ির সামনে কলাগাছ দিয়ে বানানো হতো বিয়ের গেট। গায়ে হলুদের সময় মেয়ের গায়ে হলুদ লাগিয়ে পাড়ার সব মেয়েদের উঠোনে পানি ঢেলে গড়াগড়ি খাওয়ার সেসব রঙিন দিন আজও অমলিন! একটা সময় বাড়ির ছেলে ও তাদের বন্ধুরাই খাবার পরিবেশনের দেখভাল করতেন। আর এসব কাজে বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হয় চাক্ষুসভাবে। শত হলেও নিজের ছেলে কিংবা মেয়ের বিয়ে বলে কথা। এখন সেসব নেই। বদলে গেছে বিয়ের রীতি। এখন ‘ইন্সট্যান্ট’ এর যুগ। তা কফি বানানোই হোক কিংবা বিয়ে। আনুষ্ঠানিকতা বাড়লেও কমেছে আন্তরিকতার ছোঁয়া। দীর্ঘ দিনের সেসব আয়োজন এখন বর্তমান শতাব্দীর ‘প্রযুক্তিনির্ভর জীবন’ এ এসে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর তাই তো বদলে যাচ্ছে শত শত বছরের সব আচার, রীতি ও আয়োজন। এখন এমনও সংস্কৃতি দেখা গিয়েছে পিতা-মাতার অগোচরে বিবাহ করা। যুগের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের দাবিও যেন বদলাচ্ছে আজ। সেই সঙ্গে বিয়ে বাড়ি থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে পিতা-মাতাদের মতামতের প্রাধান্যের। আগে দুইপক্ষের পিতা-মাতারা একসঙ্গে বসত, ভাব বিনিময় করত। এতে করে পরস্পরের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি পেত লক্ষণীয়ভাবে যার বদল এসেছে এখন সবকিছুতেই। এলাকার ঘটকের পরিবর্তে ইন্টারনেটে ‘ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট’ এ বিয়ের পাত্র-পাত্রী খোঁজা, টুপির বদলে বরের জন্য বাহারি পাগড়ি কেনা, কনের শাড়ির জন্য ডিজাইনারকে ডাকা- এসব কিছুরই বদল হয়েছে। বদলে গেছে বিয়ের প্যান্ডেল বানানোর প্রচলন।
সংস্কৃতির যে সংস্কার সমৃদ্ধি আনে সেই সংস্কারই আনা প্রয়োজন। অন্যথায় সংস্কৃতির প্রতি অন্যায় করা হয়। আর এই অন্যায় একদিকে যেমন হয় সংস্কৃতির সঙ্গে তেমনি অন্যদিকে হয় আমাদের পিতা-মাতাদের সঙ্গে। এসব অন্যায়ের অবসান দরকার। পিতা-মাতার মতামতের প্রাধান্য অবশ্যই দিতে হবে। তাদের দায়ভার সন্তানকেই নিতে হবে।
নটর ডেম কলেজ, ঢাকা থেকে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: