ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

কদর কমেনি এখনও

কলাপাতায় ভাত ॥ বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ২২:২২, ৫ মার্চ ২০২২

কলাপাতায় ভাত ॥ বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য

সমুদ্র হক ॥ বাঙালীর ঐতিহ্যের সংস্কৃতি কলাপাতায় ভাত। এখন চোখে পড়ে কালেভদ্রে। অতীতে গ্রামে মজলিশে, আত্মীয়-স্বজনের সমাবেশে কলাপাতায় খাওয়ার পারিবারিক বন্ধনে ছিল মধুময়তা। বিজ্ঞানীরা আগেই বলেছেন কলাপাতা ঔষধি। এই পাতায় ভাত তরকারি মেখে খেলে শরীর দ্রুত হজমের দিকে টেনে নেয়। এছাড়া কলাপাতার অন্যান্য ঔষধি গুণাগুণ তো আছেই। কলাপাতার ইতিহাসে জানা যায়, দক্ষিণ ভারতে ভাত পরিবেশনের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি কলাপাতা। প্রাচীনকালে বাংলাদেশে বিয়ে-শাদি, শ্রাদ্ধ ও চল্লিশার অনুষ্ঠানে কলাবাগান থেকে কলাপাতা কেটে (অথবা কিনে এনে) খাবার পরিবেশন করা হতো। কালের পর কাল অতিক্রম করে কলাপাতায় ভাত পরিবেশনের রেওয়াজ চলে আসছে। কলার কদর বিশ্বজুড়ে। দেশে কলাগাছের আবাদ বেড়েছে। ভর বছর কলা মেলে। কলাপাতার মতো কলার গুণাগুণ অনেক। বছরে তিনবার কলার আবাদ করা যায়। প্রথম রোপণ আশ্বিন থেকে কার্তিক। দ্বিতীয় রোপণ মাঘ ফাল্গুন। তৃতীয় রোপণ চৈত্র বৈশাখ। দুই মিটার অন্তর চারা রোপণ করতে হয়। এই তিন সময়ে রোপণের পরবর্তী দু’তিন মাসের মধ্যে ফলন মেলে। কলার অনেক নাম। সবরি, অমৃতসাগর, সাগর দুধসর, দুধ সাগর, চিনি চাম্পা, চাঁপা কবরি, চন্দনকবরি, কাঁঠালি। বীজযুক্ত কলার মধ্যে অন্যতম এঁটে, বেহুলা, মন্দিরা ইত্যাদি। কলার যত নামই হোক কলাপাতার ধরন একই। দূর অতীতে কলাপাতায় বর্ণমালা লেখা হতো। প্রাচীন সাহিত্যে কলার নাম ‘কদলি’। কলাগাছের ধরন কোনটি মোটা লম্বা ও কোনটি অপেক্ষাকৃত ছোট। হালে টবেও কলাগাছ তৈরির চেষ্টা চলছে। কলাবাগানে কলাপাতা ছেয়ে থাকে। কলাপাতা সরল পত্রভিত পুরু ও পত্রফলক প্রশস্ত। পত্রফলকে দৃঢ় মোটা ও স্পষ্ট মধ্যশিরা বিদ্যমান। মধ্যশিরার দুই ধারে সমান্তরাল শিরাগুলো বিন্যাসিত হয়। একান্তরক্রমে পাতাগুলোর উৎপত্তি ঘটে। এই পাতা নিয়ে বিশ্বে গবেষণা শুরু হয়েছে অনেক আগে। এখনও থেমে নেই। দেশে কলাপাতার চাহিদা বেড়েছে। বগুড়ার মহাস্থানগর এলাকার কলাচাষীরা পাতা বিক্রিও করছে। মাঝারি চৌকোণা আকৃতির প্রতি এক হাজার কলাপাতা বিক্রি হচ্ছে আটশ’ টাকায়। কলাবাগানের চাষী আশরাফ আলী জানালেন, কলা বেচাকেনার সঙ্গে বাড়তি হিসাবে কলাপাতা বিক্রি হচ্ছে। আগে গ্রামের মজলিশের জন্য কলাপাতার অর্ডার দেয়া হতো। এখন সেই মজলিশ আর নেই। স্মৃতিচারণে বললেন, মজলিশের আয়োজন হতো নাড়া পড়ে থাকা জমিতে। লম্বা করে খড় বিছিয়ে বসার আয়োজন হতো। লোকজন বসার পর দুই প্রস্তের কলাপাতা দেয়া হতো। যাতে মোটা মধ্যশিরা দুই ধারে রাখা যায়। এতে ভাত পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এই কলাপাতার ওপরে প্রথম একদল লবণ, দ্বিতীয় দল ভাত, তৃতীয় দল আলুঘাটি পরিবেশন করে। শেষ পর্বে কলাপাতার ওপর প্রথমে গুড় ও পরে সাদা টক দই দেয়া হয়। অতীতে কোন গ্রামে আত্মীয়-স্বজনদের বড় সমাবেশে দুপুরের খাবারে কলাপাতায় ভাত দেয়া হতো। কলাপাতায় খাবারের স্বাদই আলাদা ছিল, এমনটি জানিয়ে বগুড়ার প্রবীণ ব্যক্তি আবু বকর সিদ্দিক বললেন ভাত তরকারি তৃপ্তির সঙ্গে চেটেপুটে খাওয়ার পর কলাপাতার আলাদা একটা গন্ধ নাকে লেগেই থাকত। সেই কলাপাতার খাবার আর নেই। এখন গ্রামেও পৌঁছে গেছে শোলার তৈরি ওয়ানটাইম প্লেট বাটি। কলাবাগানের মালিক শফিকুল ইসলাম বললেন, কলাপাতা এখন আর মজলিশে যায় না। কলাপাতা কিনে নিয়ে যাচ্ছে ডেইরি ফার্মের লোকজন, জেলে ও বিভিন্ন কোম্পানি। ডেইরি ফার্মে দুধ দোহনের পর প্যাকেটজাতের আগে বালতিতে রেখে কলাপাতা দেয়া হয়। কলাপাতায় দুধ অনেকক্ষণ রাখলে টাটকা থাকে। এরপর প্যাকেটজাত করা হয়। জেলেরা মাছ ধরার পর খাঁচায় রাখে কলাপাতার মধ্যে। কলাপাতায় মাছ সহজে নরম হয় না। বর্তমানে ওষুধ কোম্পানির লোকজনও কলাপাতা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এক সূত্র জানায়, সবুজ কলাপাতার রসের চাহিদা বেড়েছে ইউরোপ ও আমেরিকায়। কলাপাতার রসে বহু রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কলাপাতার রস সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিচ্ছে বিদেশে। ওষুধ কোম্পানিগুলো কলাপাতার রসে নানা ধরনের ওষুধ তৈরি করছে। কলাপাতার রসে সর্দিকাশি শ্বাসকষ্ট অম্ল গ্যাস দূর হয়। উচ্চ রক্তচাপ দূর হয়ে লিভার সতেজ রাখে। কলাপাতার ক্লোরোফিল অন্ত্রের ঘা চর্মরোগ দূর করে। কলা এবং কলাপাতার যত গুণাগুণ আছে অন্য ফলে ততটা নেই। কলাপাতায় নানা ধরনের রান্নাও শুরু হয়েছে। একজন গৃহিণী জানালেন, কলাপাতায় ইলিশ মাছ মুড়িয়ে পাতুরি রান্নার স্বাদ আলাদা। পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে এই পাতুরি বিক্রি হচ্ছে। শহরের ভাজাপোড়ার বিক্রেতারা কলাপাতায় সেদ্ধবুট দেয়। অতীতের সেই মজলিশ নেই, তবে কলাপাতার কদর অতীতেও ছিল আজও আছে। কলাপাতা নিয়ে গবেষণা চলমান।
×