ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ছুঁয়ে দিলে মিলিয়ে যায়

যেন নতুন বউ, লজ্জাই ভূষণ লজ্জাবতীর

প্রকাশিত: ২১:২২, ১৮ জানুয়ারি ২০২২

যেন নতুন বউ, লজ্জাই ভূষণ লজ্জাবতীর

মোরসালিন মিজান ॥ লজ্জা শরম সব তো আসলে গেছে। আজকের দিনে এসব নিয়ে আর কে মাথা ঘামায়? ব্যতিক্রম শুধু এক তরু। তরুটির নাম লজ্জাবতী। সে কী লজ্জা! একটু ছুঁয়ে দিলেই হলো। একটু। অমনি মূর্ছা যায়। নতুন বউয়ের মতো গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এজন্য গাছটির নাম লজ্জাবতী। ছোটরা তো বটেই, বড়রাও এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আলতো করে ছুঁয়ে দেন। ছুঁয়ে দিতে ভুল করেন না। স্পর্শ অনুভব করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মোটামুটি মাটির সঙ্গে মিশে যায় তরুটি। অদ্ভুত রোম্যান্টিক এই লজ্জাবতী এক সময় সারাদেশে ব্যাপক হারে দেখা যেত। এখন কিছুটা দুর্লভই বলতে হবে। গাছ বলতে যা বোঝায়, লজ্জাবতী ঠিক তা নয়। তবে অনন্য বৈশিষ্ট্যের এক তরু। কত তরু লতাই তো আছে পৃথিবীতে। এরপরও লজ্জাবতীকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। কারণ এর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। জগদীশ বাবু বহুকাল আগে জানিয়ে গিয়েছিলেন, গাছের প্রাণ আছে। কিন্তু লজ্জা আছে কি না, তা জানতে কোন গবেষণা হয়নি। গবেষণার প্রয়োজনও পড়ে না। লজ্জাবতী গাছ দেখে সবাই সেটি অনুমান করে নিয়েছেন! এ গাছের অদ্ভুত স্বভাব। নতুন বউয়ের মতো লাজুক। লাজুক লতা। কবিগুরু লিখেছিলেন: নাই কি রে তীর, নাই কি রে তোর তরী?/কেবলি কি ঢেউ আছে তোর?/হায় রে লাজে মরি...। এই লাজের পুরোটাই যেন নিজের মধ্যে ধারণ করেছে লজ্জাবতী। এর ইংরেজী নাম মিমোশা। বাংলার চোখে দেখলে মিমোশা তো মেয়েদেরই নাম। মেয়েরা যেমন অপেক্ষাকৃত লাজুক হয়, লজ্জাবতী তরুটি তা-ই। সবুজ পাতার মাঝে আবার গোলাপী ফুল ফুটে থাকে। গোলাকার ফুল দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। পাতা যৌগিক। দুই সারি পত্রক বিদ্যমান। সামান্য স্পর্শ পেলে একটি আরেকটির গায়ের সঙ্গে লেপ্টে যায়। প্রাণহীন শুকনো লতা পাতার মতো মাটির ওপর শুয়ে পড়ে। নিস্তেজ হয়ে যায়। তাপের প্রভাবে এবং সন্ধ্যার পর আপনি গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী। এত যে লজ্জা, কেন? রহস্যটা আসলে কী? জানতে চাইলে শেরেবাংলা কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, লজ্জাবতী গাছের পাতার গোড়ার অংশের কোষগুলো পানিতে পূর্ণ থাকে। এ কারণে সেগুলো বেশ ফোলা দেখায়। কিন্তু ডাটাগুলো হয় সরল ও সোজা। আঙুল দিয়ে পাতা সামান্য ছুঁয়ে দিলে গাছের পুরো শরীরে মৃদু তড়িৎ প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে পাতার গোড়ার ফোলা অংশ থেকে পানি বেরিয়ে বোটার দিকে নেমে যায়। আর পাতার কোষগুলোর জলের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে তা কুঁচকে আসে। নুয়ে পড়ে। তাপের প্রভাবে ও সন্ধ্যার পর আপনি নিজেকে গুটিয়ে নেয় লজ্জাবতী। গবেষণা বলছে, লজ্জাবতী প্রায় ৪শ’ প্রজাতির গুল্ম ও লতার একটি গণ (জেনাস)। এটি লেগিউম জাতীয় ফ্যাবায়েসি পরিবারের এবং মিমোসয়ডিয়া উপ-পরিবারের সদস্য উদ্ভিদ। লজ্জাবতীর সবচেয়ে পরিচিত প্রজাতিটির নাম মিমোসা পুডিয়া। আদি নিবাস মধ্য আমেরিকা। বাংলাদেশেরও খুব পরিচিত লতা। প্রায় সকল লজ্জাবতীর কান্ড সরু কাঠির মতো। অনেক শাখা-প্রশাখা। এই নবেম্বরে সুন্দর ফুলও ফুটে আছে। জঙ্গলে ফুটে থাকা গোলাপি এবং সাদা রঙের ফুলের সৌন্দর্য দারুণ উপভোগ্য। লজ্জায় ডুবে থাকা গাছের প্রাণ বড় শক্ত। আগাছার মতো হওয়ায় অনেকে একে পায়ে মাড়িয়ে যান। কিন্তু গাছটি সহজে মরে না। বরং নিশ্চিহ্ন অবস্থা থেকেও যৌবনে ফিরতে জানে। একইভাবে অনেক প্রতিকূল পরিবেশে এটি জন্মাতে পারে। কোন রোগ বা পোকা একে কাবু করতে পারে না। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশে লজ্জাবতীর দুটি জাত রয়েছে। একটি দেশীয়। অন্যটি থাই লজ্জাবতী। দেশীয় লজ্জাবতীর বৃদ্ধি কম। এটি ৩ থেকে ৭ ফুট লম্বা হয়। গায়ে সূক্ষ্ম কাঁটার অস্তিত্ব দেখা যায়। অন্যদিকে থাই লজ্জাবতী গাছে কোন কাঁটা হয় না। এটি দ্রুত বাড়ে। গাছ প্রায় ৩-১০ ফুট লম্বা হয়। গাছ নরম ও রসালো বলে দ্রুত পচে যায়। ফলে এ জাতীয় লজ্জাবতী থেকে প্রচুর জৈব সার পাওয়া যায়। তবে আখেরে সার টার নয়, লজ্জাবতীর লজ্জাটুকুই মূল আকর্ষণ। মানুষ এ কারণেই তরুটির কাছে ছুটে যায়। হঠাৎ আবিষ্কার করতে পারলে উচ্ছ্বসিত হয়। আর, হ্যাঁ, আমরা ‘লজ্জাবতী’ বলছি বটে। আসলে এ এক রহস্য। রহস্যে ঘেরা বিচিত্র্য বৈশিষ্ট্যের তরু। আসুন একে বাঁচিয়ে রাখি।
×