ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রবি ঠাকুরের সেই রতন, এখন যেমন তার উত্তরসূরিরা

প্রকাশিত: ২১:৪০, ৮ জানুয়ারি ২০২২

রবি ঠাকুরের সেই রতন, এখন যেমন তার উত্তরসূরিরা

সৈয়দ হুমায়ুন পারভেজ শাব্বির ॥ ‘যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন- সামান্য গ্রাম্য বালিকা রতনের মুখোচ্ছবি যেন বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। মনের ব্যাকুলতা পোস্ট মাস্টার বাবুকে আকুল করিয়া তুলিল, তিনি ভাবিলেন ফিরিয়া যাই। কিন্তু তখন পালে বাতাস লাগিয়াছে। আর ফিরিবার উপায় নাই। কিন্তু রতনের মনে কোন তত্ত্বের উদয় হইল না। সে পোস্ট অফিস গৃহের চারদিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। তাঁর মনে ক্ষীণ আশা দাদাবাবু যদি কখনও ফিরিয়া আসে!’ -ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে ও বিশ্বের জ্ঞান পরিম-লে ‘ভারস্যাটাইল জিনিয়াস’খ্যাত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী ছোট গল্প ‘পোস্ট মাস্টার’র রতন চরিত্রটি শাহজাদপুরের আদিবাসী বাগদি পরিবারে কোন এক তরুণীকে ঘিরেই আবর্তিত বলে শাহজাদপুরের ৩২ আদিবাসী বাগদি পরিবারের দাবি। শাহজাদপুরের আদিবাসী বাগদিদের উত্তরসূরি মৃত শশীনাথ বাগদি, অটোল বাগদি, কেদার নাথ বাগদি ও মুরালী বাগদিসহ ওই ৯টি পরিবারের সদস্যরা কবিগুরুকে পালকিতে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন। বর্তমানে পালকি বাহনের পেশা প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় কবিগুরুর সেই পালকি বাহক এবং রতনের উত্তরসূরি শাহজাদপুরের ৩২টি আদিবাসী বাগদি পরিবারের ২’শতাধিক আদিবাসী বাগদির প্রতিটি দিন কাটছে অতিকষ্টে। এদের অনেকেই পালকি বাহনের পেশা পরিত্যাগ করে স্বল্প আয়ের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে। ৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে শাহজাদপুর পৌর এলাকার মনিরামপুর বাজার সংলগ্ন কবিগুরুর কাছারি বাড়ির কয়েকশ’ গজ পূর্বদিকে অবস্থিত আদিবাসী বাগদি পল্লী পরিদর্শনকালে মৃত যতীন চন্দ্র রায়ের ছেলে মনোরঞ্জন চন্দ্র রায় (৬৫), মৃত শ্যাম চন্দ্র রায়ের ছেলে বাবলু চন্দ্র রায় (৫৯), শিবু চন্দ্র রায় (৬২), মৃত সিরিস চন্দ্র রায়ের ছেলে বিশা চন্দ্র রায় (৬৬), বিজয় চন্দ্র রায়ের স্ত্রী কাননবালা রায়সহ (৭০) অনেকেই অক্ষেপ করে বলেন, ‘শাহজাদপুর জমিদারি একদা নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারির অংশ ছিল। ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় এই জমিদারি কিনে নেন। জমিদারির সঙ্গে সঙ্গে শাহজাদপুরের কাছারি বাড়ির ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৮৯০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি দেখাশোনার কাজে কবিগুরু শাহজাদপুরে এসেছিলেন। এখানে জমিদারি তদারকির কাজে তিনি বিভিন্ন স্থানে পালকিতে ভ্রমণ করতেন। শাহজাদপুরে আসার সময় এ ভ্রমণের জন্য কবিগুরু ভারতের বর্ধমান জেলা থেকে ৯টি আদিবাসী বাগদি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় নানাভাবে উঠে এসেছে শ্রমজীবী এই আদিবাসী বাগদি পরিবারের কথা। কবিগুরুর কালজয়ী ছোটগল্প পোস্ট মাস্টারের রতন চরিত্রটি শাহজাদপুরের বাগদি পরিবারে কোন এক তরুণীকে ঘিরেই আবর্তিত বলে আদিবাসী বাগদি পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তবে রতন নামটি হয়তো বা ছিল কাল্পনিক। রতনের উত্তরসূরি এসব আদিবাসী বাগদিদের বসবাসের জন্য কবিগুরু কাছারি বাড়ি সংলগ্ন স্থানে তাদের ৩ বিঘা ১৭ শতক জমি দান করেন। দিনে দিনে আদিবাসী বাগদি পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২’শতাধিকে দাঁড়িয়েছে। বসবাসের জন্য এ স্বল্প জায়গায় এদের বসবাস কষ্টকর হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে সিও অফিস কোয়ার্টার ও ভেটেরিনারির অফিস নির্মাণের জন্য ওই জমি অধিগ্রহণ, হুমুকদখল ও দখলে দখলে বর্তমানে ১২ শতকে দাঁড়ালেও কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি তারা। দখল হয়ে যাওয়া জমি ফেরত পেতে তারা ধারদেনা করে দ্বারে দ্বারে অনেক দৌড়ঝাঁপ করলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। তাদের কেবল মিলেছে আশ্বাসই। কেউই তাদের খবর রাখে না! দেশের আর সবার মতো সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুন্দর পরিবেশের বসবাসের জন্য দখল হয়ে যাওয়া জমি ফেরত চায় শাহজাদপুরের আদিবাসী বাগদিরা। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, হরিজন সম্প্রদায়ের আধা যাযাবর এই বাগদি পরিবারগুলোর আদি নিবাস ছিল ভারতের বর্ধমান জেলায়। ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহ, চুন তৈরি এবং কুলির কাজ করাই ছিল এদের প্রধান পেশা। ১৮৯০ সালের ২০ জানুয়ারি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার কাজে শাহজাদপুরে আসেন। এ সময় তার সঙ্গে পরিচিতি ঘটে হরিজন সম্প্রদায়ের ওই আদিবাসী বাগদিদের। আদিবাসী বাগদিদের সরলতা আর স্বকীয়তাবোধ কবিকে প্রভাবিত করে। এক সময় এদের ৯টি পরিবারকে কবি তার পালকি বাহকের কাজ দেন। এ সময় কবিগুরু তাদের বসবাসের জন্য ৩ বিঘা ১৭ শতক জমি তাদের নামে বন্দোবস্ত দেন। স্থানীয় আদিবাসী বাগদি পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য অভিযোগ করে বলেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের ৩ বিঘা ১৭ শতক জমি বন্দোবস্ত দিলেও বর্তমানে তারা মাত্র ১৪ শতক জমি ভোগ দখল করছে। অতি স্বল্প পরিসরের ওই জায়গায় অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি আদিবাসী বাগদিদের বসবাসই তাদের জন্য দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময়ে সরকারী প্রয়োজন দেখিয়ে তাদের ৩ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ফলে দিন দিন তাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও মাত্র ১৪ শতক জায়গার ওপর ঠাসাঠাসি করে বর্তমানে তারা বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।’ বিজ্ঞমহলের মতে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আদিবাসী বাগদি পরিবারগুলোর অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক ছিল। এরাও ইতিহাসের সাক্ষী। যে কারণে শুধু রাষ্ট্র কিংবা সরকারের নয়, আপামর জনতার উচিত অমানবিক অবস্থা হতে এই পরিবারগুলোকে রক্ষা করা, ওদের পাশে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়া। সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশে ওদের বসবাসের সুযোগ করে দেয়।
×