ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় অপরিহার্য, আদিকাল থেকে আজও..

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ২৩ অক্টোবর ২০২১

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় অপরিহার্য, আদিকাল থেকে আজও..

শ আ ম হায়দার ॥ বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়েলী গীত বাঙালীদের জীবনঘনিষ্ঠ। আদিকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। তবে বিয়েতে মেয়েলী গীতের প্রথা এখনও টিকে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে, যা বাঙালী লোকসংস্কৃতির এক অন্যতম অনুসঙ্গ। এর উদ্ভব হয়েছিল প্রধানত হিন্দু সমাজে, মঙ্গলকাব্যে। পরে ইসলামী শরিয়তে বিধি নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মুসলমান সমাজে এ গীত সমাদৃত হয়ে আসছে। এসব গীত আঞ্চলিক ভাষায় গ্রামীণ মহিলাদের নিজস্ব ছন্দেই রচিত । তারা সুপ্রাচীনকাল থেকেই নিজেরাই রচনা, সুর এবং পরিবেশন করেছেন মুখে মুখে। তারা অধিকাংশই নিরক্ষর,অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত । গীত রচনা বা সুর রপ্ত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, নেই কোন বাদ্যযন্ত্র । যখন রেডিও মাইক , টিভির দাপট ছিল না, তখন বিভিন্ন বয়সী মহিলারাই পান্ডুলপি ছাড়াই মুখে মুখে নাচে গানে বিয়ের আসর মুখর করে রাখতেন । অন্যদিকে মেয়েলী গীত এক প্রকার লোকগীতি। সে কারণে বাঙালী সংস্কৃতিতে লোক সঙ্গীতের যে কয়েকটি ধারা ক্রমান্বয়ে লোক সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তার মধ্যে বিয়ের গান অন্যতম। লোক সাহিত্যের এক অমূল্য ভান্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে এ গীত। যা ধারক ও বাহক বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের। এখন আধুনিক সমাজ-সংস্কৃতিতে প্রাচীন এসব বিয়ের গীতের পরিবর্তে যুক্ত হয়েছে নব্য আবিষ্কৃত ব্যান্ড সংস্কৃতি। চলমান সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় এসবকে সেকেলে মনে করায় হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গীত । তারপরও এখনও গাঁও-গেরামে এ গীত ও গানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। উত্তরাঞ্চলের গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন স্থান ঘুরে বিয়ের গীতের রেওয়াজ চোখে পড়ে। তারমধ্যে রংপুর অঞ্চলে এ গীতের প্রভাব এখনও টিকে আছে। মেয়ের পক্ষ থেকে মেয়েকে বিদায় দেয়া থেকে পাত্র পক্ষের বাড়িতে পাত্রের গায়ে হলুদ থেকে পরের দিন বৌভাত পর্যন্ত বিয়ের গান চলে। আবার কোথাও বিয়ের অনুষ্ঠানে জলচৌকির ওপরে কনে সেজেগুজে বসে থাকে, আর পাড়া- প্রতিবেশীর মেয়েরা দল বেঁধে গীত গায়। গাইতে গাইতে নাচে অংশ নেয় মধ্যবয়সী মহিলারাও। তারা দলবদ্ধভাবে নিজেদের মতো ভঙ্গিমা ও মুদ্রায় নাচ গান করে । এসব অনুষ্ঠানে গীত গাইয়ে কিছু মহিলারাও দল বেঁধে এসে গীতের তালে তালে আকর্ষণীয় ছন্দ ও তালে নাচে গানে আসর মাত করে তোলে। গীত গাইয়েরা অসংখ্য গীত মুখস্ত বলতে পারে যেমন গাও হ্যালানি দিয়া নাচ রে গোলাপী/ চুল হেলানী দিয়া নাচ রে গোলাপী/ গোলাপী মোর দুধের সর/ ক্যামনে যাইবে পরের ঘর, ছোট ছোট কারেঙ্গা ঢাল ঢাল পাত/ শহরে মেলিয়া গেল পাতরে মারওয়া ভালবাসো তোরে , খোলাহাটির বালু চরে সায়মোনা টাঙ্গাইছেরে লাল ময়না তোরই কারণে রে/ তোমার বাবা জবান দিছে ভরা সভার মাঝেরে/ দুপাইরা আইদের মাইদেরে পালকি/ পালকি চলছে রবে রবে/ পালকির কাপড় তুইলা গো দেখি লাইলীর আব্বা আইসে নাই সাতে/ দাঁত ড্যাংরা বরের বওনাই মিছাই দেখান ভাও/ কোনবা ভাগ্যে পাইনেন তোমরা চান্দের মতন ছাও পাইর বান্দে পাথুরী রে কালাচান/ হেচিয়া পেন্দো তার ধূতি হে কালাচান/ বসিয়া পেন্দো তার ধূতি হে কালাচান। দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলায় বিয়ের একদিন আগে বরের গায়ে হলুদ দেয়া অনুষ্ঠান হয় । এসময় গ্রাম প্রতিবেশী নারীরা নিত্যগীত করে । পরের দিন কনে আসার পর বরের বাড়িতে সকাল থেকেই চলে মেয়েলী গীত ও রংয়ের হোলি খেলা। ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামাঞ্চলে বিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বিদায় নিয়ে কনে আসে বরের বাড়িতে । তার পরদিন বরের বাড়িতে শুরু হয় বিয়ের গীত। চলে বৌভাতের দিন দুপুর পর্যন্ত । এসময় বর-কনেকে এক চাদরে বেঁধে আত্মীয়স্বজনরা মেতে ওঠে বিভিন্ন খেলায়। গোয়াল ঘরের গোবর ফেলা, জমিবাড়ি থেকে মাটি আনা , সবজিখেত থেকে শাক-সবজি তোলা এসব প্রতীকী কাজ করান নতুন বৌকে দিয়ে। এছাড়াও বরের ভাবি, দেবর, ভগ্নিপতি, দাদি ,ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী মিলে মেতে ওঠে নানান খেলায়। বিয়ের পরে কন্যা চলে যাচ্ছে শ্বশুরালয়ে। তাই ঘর ভাসিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে কন্যা ও তার পিতা-মাতা। তাই কন্যা গাড়োয়ানকে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে বলছে। কারণ, যতক্ষণ দেখা যায় তার ফেলে আসা শৈশবের স্মৃতি। শ্বশুরালয়ে এলে দামাদ (স্বামী) তার স্ত্রীকে সান্ত¦না দেয়। বিয়ের পর কাজের জন্য স্বামী গেছে দূর দেশে, তার জন্য স্ত্রী ছটফট করে, ভারাক্রান্ত মনে দিন কাটায়। অনেকদিন পরে কন্যা আসবে জননীর কাছে, তার প্রতীক্ষায় সর্বকালীন মাতৃহৃদয়ের আকুতি। কোন রকমের পূর্ব প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই গাঁও-গেরামের অশিক্ষিত ললনা ও গ্রাম্যবধূদের এ গীত যেন হৃদয় স্পর্শ করে। এদেশের মৃত্তিকায় ও জলবায়ুতে গ্রামীণ গণমানুষের জীবনযাপন , আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন, কামনা-বাসনা এসব মৌলিক গানে বিধৃত হয়েছে। আবার রঙ্গরসিকতার গানও রয়েছে। ঢোলক বাজিয়ে তালি মেরে সামান্য কোমর দুলিয়ে গানটি গীত হয়। প্রাণের স্পন্দন ও আবেগ উল্লাস ব্যক্ত হয় গানটি পরিবেশনের সময়। কখনও একক কণ্ঠে, আবার মিলিত কণ্ঠের রোমান্টিক গানও রয়েছে । গানটি এক এক অঞ্চলে একটু পরিবর্তন করে গীত হয়ে থাকে। যেমন- কালোরে ভ্রমর বাঁশী রইলি বিদেশে/ আমার যেমন কোমর তেমনি বিছে গড়িয়ে দেবে কে? / আমি কোমর হিলায়ে চলে যাবো দেখবে আমায় কে? অঞ্চলভেদে গীতের লিরিকে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। কিশোরগঞ্জ বা সুনামগঞ্জের হাওড়বেষ্টিত দুর্গম অঞ্চলের গান অন্য আঙ্গিকে রচিত। সিলেট অঞ্চলে বিয়ের দিন কিংবা বিয়ের আগে ধামাইল নামের একটি মেয়েলী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠানে সাধারণত মহিলারা গীত গেয়ে থাকেন। সিলেটের বেশ কিছু আঞ্চলিক বিয়ের গান রয়েছে, যেগুলো প্রায় সব বাড়ির নারীরাই জানেন। তাই গীতের সঙ্গে প্রায় সবাই গলা মেলাতে পারে। গীতের তালেতালে নরীরা তুলে ধরেন বরের মেজাজ, কনের চালচলন । গানের অনুষ্ঠানে কখনও কনেকে ঘিরে, কখনও আলাদাভাবে নারীরা একত্রিত হয়ে কোমরে শাড়ি পেঁঁচিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিয়ে মটিতে পা দিয়ে তাল ঠুকে ঠুকে নাচতে থাকেন। নাচের তাল কেবল একটিই- একটু সামনে, সকলে একত্রে এগিয়ে গিয়ে একবার হাততালি, আবার পেছনে এসে পরবর্তী হাততালির প্রস্তুতি। বয়স্ক নারীরা অর্থাৎ বর-কনের মা-কাকি-মাসিরা যখন বিয়ের অনুষ্ঠানে নৃত্যগীত পরিবেশন করেন, তখন তাদের ঘিরে থাকে শিশু-কিশোররা। এরা বড়দের গান শোনে এবং মনের মধ্যে গেঁথে নেয়। এরপর যখন তারা বড় হয় তখন তারা নিজেরাই গাইতে থাকে। এভাবেই চলে আসছে। যুগের পরিবর্তনে গ্রামাঞ্চলের অনেক স্থানেই মেয়েলী গানে যন্ত্রের তথা হারমোনিয়াম, দোতারা, তবলা ইত্যাদির ব্যবহার চালু হয়েছে। পেশাদার গীত গাইয়েরা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৃত্য-গীত পরিবেশন করে । বেশ কয়েক যুগ ধরে বিয়ের গীতসহ সকল অনুষ্ঠান ভিডিওর মাধ্যমে সংরক্ষণ করে রাখার রেওয়াজ চালু হয়েছে । প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ অতুল সুর এ দেশীয় বিয়ের ইতিহাস বর্ণনায় বলেছেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভৌগোলিক অবস্থান ও সংস্কৃতি অনুযায়ী বিয়ের রীতিনীতি পাল্টেছে। পাল্টেছে গানেরও। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই উপমহাদেশের বিয়েতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। আর এটা করত অন্তঃপুরের মহিলারাই । হিন্দু বিয়েতে মেয়েলী আচার অনুষ্ঠানের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল মঙ্গল গান।পরবর্তীকালে কালের ধারাবাহিকতায় মুসলমান বিয়েতেও যুক্ত হয় এই অনুসঙ্গ। বিয়ের গীতের রচয়িতা নারী, এ গান পরিবেশনও করেন নারীরা। এর শ্রোতাও মহিলা। নারী মনের আবেগ, উৎকণ্ঠা, আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্না, সুখ ও আনন্দের প্রকাশ ঘটে বিয়ের গানে। আবার পাশাপাশি নতুন দাম্পত্য জীবনের হাসি-ঠাট্টা, পরস্পরকে চেনার আনন্দ মিশে থাকে গানের কথায় প্রচলিত সুরে । লোকগীতি গবেষক শ্যামল বেরা বলেছেন, সাহিত্য শিল্পাশ্রয়ী লোক-সংস্কৃতির মধ্যে বিয়ের গান খুবই তাৎপর্যবহ। এ গান নারীদের দ্বারা সৃষ্ট, নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সমাজ জীবনের চিত্রায়ণ। আমাদের সমাজ বিবর্তনের ধারাটি বুঝতে হলে এসব লোকায়ত গানের দ্বারস্থ হতেই হবে। এসব গানে লোকসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় এবং গীত হয় লোকসঙ্গীতের বিশেষ সুরে। এ গানগুলো আজও রেকর্ড বা লিপিবদ্ধ হয়নি। মৌখিকভাবে সৃষ্ট গানগুলো রয়েছে মানুষের স্মৃতিতে। বাঙালীদের অতীতের দিনযাপন কৃষ্টি কালচার কেমন ছিল তার ধারক বাহক এই বিয়ের গীত। ক্রমান্বয়ে গায়েনদের স্মৃতি থেকে বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে। বংশ-পরম্পরায় ও কালের ধারাবাহিকতায় এসব গানের শ্রষ্টা ও গায়েন, যারা এখনও জীবিত আছেন, তাদের বয়সও পড়ন্তবেলার দিকে। তাদের মধ্যে যে কয়জনের স্মৃতিতে ক্রমবিলীয়মান ঐতিহ্যের যেটুকু আজও টিকে আছে তা সংগ্রহ করতে পারলে অনেকখানি কাজ হবে। তা না হলে যেভাবে গীতগুলোর রূপান্তর ঘটছে, তাতে অচিরেই মেয়েলী নৃত্য, গীত-গান হারিয়ে যাবে বাঙালীদের দৃশ্যপট থেকে।
×