ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আব্দুল আউয়াল খান

প্রাইভেট বনাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ২৩ এপ্রিল ২০২১

প্রাইভেট বনাম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

প্রফেসর, চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয় (অবঃ) ও উপাচার্য, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি (শেষ পর্ব) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা বা যুক্তি-তর্কের কমতি নেই। বিষয়টি জন গুরুত্বপূর্ণও বটে। এক দিকে যেমন কতিপয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেশে মানবসম্পদ উন্নয়নে অপরিহার্য অবদান রেখে যাচ্ছে নিষ্ঠা ওক্ষতার সাথে; ঠিক অপরদিকে ভুইফোর কতিপয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে তৈরী করে যাচ্ছে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা। তবে ভাল-মন্দ মিলিয়েই দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা এখন আর থেমে থাকার মত বিষয় নয়; বরং যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং-এর মাধ্যমে একে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে সচল রাখাই কর্তৃপক্ষের সামনে একটা বড় দায়িত্ব। জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা ৫-দফা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সেশনজ্যাম (ঝবংংরড়হ লধস) সমস্যা তৈরী হয়েছিল তা থেকে রক্ষা পাবার উপায় হিসেবে বিপুল সংখ্যকছাত্র-ছাত্রী উচ্চ-শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ যেতে শুরু করে। শুধু ১৯৯১-’৯২ সালেই এরূপ প্রায় ১০,০০০ (দশ হাজার) ছাত্র-ছাত্রী ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এতে দেশের কষ্টার্জিত বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়হয়। অনতি বিলম্বে প্রাইভেটবিশ্ববিদ্যালয় আইন(১৯৯২) পাশের মাধ্যমে দেশে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ক্রমান্বয়ে ’৯০-এর দশকেই উক্ত আইনের আওতায় কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিতহয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে বেশ কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব হয় এবং বর্তমানে (২০২১-এ) এরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হচ্ছে মোট ১০৭টি; যদিও এরমধ্যে ৮/৯টি বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। দেশের উচ্চ-শিক্ষা ক্ষেত্রে এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট অধ্যয়ণরত শিক্ষার্থীর সংখ্যাপ্রায় ৩,৪৯,১৬০ জন। প্রতি সেমিষ্টাওে আন্ডারগ্রেড পর্যায়ে নতুন ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদেও জন্য মোট সিটসংখ্যা প্রায় ১,৮৫,১৫৭ টি এবং গ্রাজুয়েট পর্যায়ে ৯২,৯৮৯ টি। ২০১০-২০১৯ এই দশ বৎসওে ডিগ্রীপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫,৯৪,৭৫৩ জন (সূত্র: ৪৬ তমবার্ষিকপ্রতিবেদন ২০১৯ বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরীকমিশন)। উল্লেøখ্য যে, এই বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর একটা বিরাট অংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ায় একদিকে যেমন অপূরণীয় ক্ষতিহতো এদের ব্যক্তিগতজীবনে, ঠিকঅন্যদিকে দেশওক্ষতিগ্রস্ত হতো মানবসম্পদেও অনাকাঙ্খিত অবক্ষয় ও অপচয়ে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিগত তিন দশকে সংখ্যায় বেড়েছে অনেক, কিন্তু কর দাতা (ঞধী ঢ়ধুবৎ)-দেও টাকায় পরিচালিত হয়ে গুনগতদিক থেকে এদেরউন্নতি-অগ্রগতী প্রশ্ন-সাপেক্ষ। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের ন্যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়েও গর্ব করার আর কিছু অবশিষ্ট্য আছে বলে মনে হয়না। বস্তুতঃ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের আওতাধীনে রয়েছে বিশাল অবকাঠামোগত ও জনবলসংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা এবং রাষ্ট্র বহনকরে এদের মোট বাজেটের প্রায় ৯২/৯৩ শতাংশ। সে হিসাবে এদেও অবদান কি? পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ রাষ্ট্রীয় কোনরূপ আর্থিক আনুকুল্য বাদেই জনসম্পদ উন্নয়নে যেরূপসংগ্রাম কওে যাচ্ছেতা যথাযথ মূল্যায়নের দাবি রাখে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মূল সমস্যা হচ্ছে দলীয় রাজনীতি। মানসম্পন্ন শিক্ষক-গবেষকের তুলনায় ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করে থাকে বিশেষ রং (সাদা/নীল/পিঙ্ক) সম্বলিত প্যানেলের তথাকথিত শিক্ষক নেতা-নেত্রীবৃন্দ। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মূল সমস্যা (কিছুকিছু ক্ষেত্রে) হচ্ছে নি¤œমান সম্পন্ন মালিকশ্রেণীর অপেশাদারী ও নৈতিকতা বিবর্জিতআচরণ। এদেরকে নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব হলে সামগ্রিকভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ শিক্ষা ও গবেষনা ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন (ঠধষঁব ধফফরঃরড়হ)-এর দিক দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সহজেই অতিক্রম করতে সক্ষম হবে বলে অভিজ্ঞমহলের বিশ্বাস; কেননা এসকল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই দলীয় রাজনীতি, নেই করদাতাদের অর্থেও অপচয়। তবে এদেও টিকতে হবে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষনা নিশ্চিতের মাধ্যমেই। কতিপয় প্রাইভেটবিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই যে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশমূখী না হয়ে এই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে উৎসাহী হওয়ায় একদিকে যেমন তারা হচ্ছে উপকৃত, ঠিক দেশও রক্ষা পাচ্ছে সম্ভাব্য অনেক সামাজিক ও আর্থিক সংকটের হাত থেকে । নিরপেক্ষ দেশ প্রেমিক মাত্রেরই দৃঢ়বিশ্বাস যে, সরকারী নিয়ন্ত্রন সংস্থাসমূহ (মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, ব্যাক) যথাযথ সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে বিপথগামী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও নিকট ভবিষ্যতে এদেও উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন নিশ্চিতে সক্ষম হবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বহু পূর্বেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠত্ব সংক্রান্ত ভাবনাকে ম্লান করে দিয়েছে। ঐ সকল দেশের শ্রেষ্ঠসব বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রাইভেট সেক্টরে। “সরকার অর্থই হচ্ছে ইধফ গধহধমবৎ”-এ কালজয়ী বক্তব্যটি যে কোনও দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ও বাস্তবসত্য বলে প্রমানিত। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। রাষ্ট্রের জন্য একমাত্র কাজটি হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় লেজুরবৃত্তি থেকে মুক্ত করা এবং পেশাদারিত্ব নিশ্চিতের মাধ্যমে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশকে দুর্নীতিমুক্ত করা।
×