ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁশখালীতে ত্রিমুখী সংঘর্ষ

প্রকাশিত: ২৩:২২, ১৮ এপ্রিল ২০২১

বাঁশখালীতে ত্রিমুখী সংঘর্ষ

চট্টগ্রাম অফিস/নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঁশখালী ॥ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গন্ডামারায় বাস্তবায়নাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে পুলিশ, শ্রমিক ও গ্রামবাসীর ত্রিমুখী সংঘর্ষে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৬ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন। এরমধ্যে গুলিবিদ্ধ ১৪ জন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সংঘর্ষ থামলেও এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনাস্থলে ছুটে যান চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মুমিনুর রহমান, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হকসহ র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা। এর আগে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে এস আলম গ্রুপের ওই বিদ্যুত কেন্দ্রের ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। স্থানীয়রা জানায়, বেশকিছু দিন যাবত বিদ্যুত কেন্দ্রের ভেতরে শ্রমিকদের মাঝে বকেয়া বেতনভাতা আদায় নিয়ে বিক্ষোভের গুঞ্জন চলছিল। সেই গুঞ্জন প্রকাশ্য রূপ নেয় শুক্রবার রাত থেকে। কেন্দ্রের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শ্রমিকদের আলাপও হয়। বকেয়া বেতন পরিশোধসহ ১১টি দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি-দাওয়া নিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্রের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর কথা জানায় প্রকল্পের কর্তারা। এরমধ্যে শ্রমিকরা শনিবার সকাল থেকে কাজে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। সেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গেলে অবস্থা আরও উত্তপ্ত হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছুড়তে থাকে। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ প্রথমে ফাঁকা গুলি ও পরে গুলিবর্ষণ করে। দু’পক্ষের সংঘর্ষে প্রকল্প এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরে এলাকার লোকজন প্রকল্পের ভিতরে গিয়ে আহত ৩৪ জন শ্রমিককে উদ্ধার করে। এরমধ্যে ১৬ জনকে বাঁশখালী হাসপাতালে নেয়া হয়। যারমধ্যে ৪ জনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। গুরুতর আহত ১২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালে প্রেরণ করা হয়। সেখান থেকে একজনের মৃত্যু ঘটে। বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ শফিউর রহমান মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আহত অনেককে আনা হয় চিকিৎসার জন্য, যারমধ্যে গুরুতর ১২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। আহতদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ। সংঘর্ষে নিহতরা হলেন- আহমদ রেজা (১৮), রনি হোসেন (২২), শুভ (২৪), মোঃ রাহাত (২২) এবং রায়হান (১৮)। এরমধ্যে শেষোক্ত জনের মৃত্যু হয় চমেক হাসপাতালে। আহত ১৪ জন চমেকে চিকিৎসাধীন আছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই শিলাব্রত বড়ুয়া। চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর আহতদের মধ্যে যাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন- হাবিব উল্লাহ, মিজান, মোঃ শাকিল, মোঃ মুরাদ, মোঃ কামরুল, মোঃ দিদার, আমিনুল হক, মাসুম আহমেদ, অভি, রাহাত এবং ওমর। এছাড়া গন্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির তিন সদস্যও হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তারা হলেন- ইয়াসির, আবদুল কবির ও আসাদুজ্জামান। পুলিশ, শ্রমিক এবং গ্রামবাসীদের বিভিন্ন সূত্র জানায়, বেতনভাতা, রমজানে ইফতার ও নামাজের সময়সূচী নির্ধারণসহ বেশকিছু বিষয়ে গত কয়েকদিন ধরে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি বকেয়া পাওনার দাবিও ছিল। শনিবার সকালে ছিল শ্রমিকদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচী। সে অনুযায়ী সকাল থেকেই শ্রমিকরা বিদ্যুত কেন্দ্র এলাকায় জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে শত শত শ্রমিক বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে পুলিশে খবর দেয়া হয়। পুলিশ এলে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে গ্রামবাসীও এরসঙ্গে জড়িয়ে যায়। ত্রিমুখী সংঘর্ষে পুলিশের পক্ষ থেকে চালানো গুলিতে অকুস্থলেই চারজনের মৃত্যু হয়। বাকি একজন মারা যান চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বাঁশখালী থানার ওসি (তদন্ত) সংঘর্ষে মোট ৫ জনের মৃত্যু হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ইফতার ও নামাজের সময়সূচী এবং বেতনভাতা নিয়ে কয়েকদিন ধরে চলে আসা উত্তেজনার জের ধরে এ সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ওপরও চড়াও হয়। এতে করে ৫ পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছে বলে তিনি জানান। ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার লোকজনও ছুটে এসে প্রকল্প এলাকা ঘেরাও করে। কেন্দ্রের কয়েকটি স্থানে অগ্নিসংযোগও করেছে বিক্ষুব্ধরা। বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকায় চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে এস আলম গ্রুপ। বিদ্যুত কেন্দ্রটি শুরুতেই বাধার মুখে পড়ে। বাস্তবায়ন কাজের শুরুতেই সংঘাত। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল ওই বিদ্যুত কেন্দ্রের জায়গা অধিগ্রহণ নিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে প্রথম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল। মালিকপক্ষ এবং পক্ষে-বিপক্ষে গ্রামবাসীদের দুটি গ্রুপসহ ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়েছিল সেবারও। সেদিন চার গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়। স্থানীয় বিএনপি নেতা লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে এ আন্দোলন হয়েছিল। তদন্ত কমিটি ॥ বিডিনিউজ জানায়, বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে পাঁচজনের মৃত্যুসহ হতাহতের ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনি আক্তারকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে বলে শনিবার বিকেলে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান চৌধুরী জানান। তিনি বলেন, কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন, কারখানা পরিদর্শক বিভাগের একজন এবং বিদ্যুত বিভাগের একজনকে প্রতিনিধি হিসেবে রাখা হয়েছে।
×