ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

হেফাজত এখন ব্যাকফুটে

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ১৪ এপ্রিল ২০২১

হেফাজত এখন ব্যাকফুটে

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ অরাজনৈতিক সংগঠনের ঘোষণায় বর্তমান সরকারবিরোধী কুচক্রী মহলগুলোর ইন্ধনে রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে দেশব্যাপী সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, তা-বলীলা চালানোর পর পরিষ্কার হয়ে গেছে আসল উদ্দেশ্য। ধর্মীয় ভাবধারায় উগ্রবাদ সৃষ্টির পন্থায় অনৈতিক সম্পূর্ণ ধর্মবিরোধী, লাম্পট্যতা পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে এসে ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণœ হওয়ার পর হেফাজতে ইসলাম এখন ব্যাকফুটে। এ সংগঠনের সঙ্গে জড়িতদের কেউ সমর্থন যোগাচ্ছে সরকারবিরোধী, আইনবিরোধী এবং ধর্মীয় রীতিনীতি ও বিধান অনুযায়ী কর্মকা-কে। আবার আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে বটে, তবে এখন প্রকাশ্যে আসছে না অবস্থার প্রেক্ষাপটে। ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতীদের অবস্থানগ্রহণ নিয়ে জামায়াত-বিএনপির ইন্ধন ছিল জোরালো। এটা পরিষ্কার হয়েছিল যখন ওইদিন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ঢাকাবাসীকে হেফাজতের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানোর পর। এরপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ্যাকশনে এরা টিকতে পারেনি। পালিয়ে গিয়েছিল নিমিষেই। পালিয়ে যাওয়ার সময় ধর্মীয় বিভিন্ন বই পুস্তক পুড়িয়ে দিয়ে নিজেদের লালসা চরিতার্থ করেছে। এর পরের ঘটনাবলী ছিল ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফী কওমি মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের স্বার্থ হাসিলে সরকারের সঙ্গে বিভিন্নভাবে আলাপ আলোচনা চালিয়ে কিছু দাবি আদায় করে নিতে সক্ষম হন। এ বিষয়টি হেফাজতের অভ্যন্তরে কিছুটা বিভক্তি সৃষ্টি করে। শফীবিরোধী গ্রুপের ইচ্ছা ছিল বর্তমান সরকার থেকে নয়, অন্য সরকার এলে তাদের থেকে দাবি দাওয়া আদায় করে নেয়ার বিষয়টি। এরপরে হেফাজত অভ্যন্তরে বিভক্তি আরও জোরালো হয়। এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন আহমদ শফী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই সময়ে তাকে ঘিরে নানাভাবে মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। তার পুত্র আনাস মাদানীকে হাটহাজারী মাদ্রাসার দায়িত্ব থেকে বহিষ্কার করা হয়। এমনকি হেফাজতের আমির পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দিয়ে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আসীন করা হয়। এর পাশাপাশি শফী সমর্থিত গ্রুপের অন্যান্য নেতাদের সরিয়ে দিয়ে কোণঠাসা করে রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, এর পরের ঘটনা আরও রহস্যেঘেরা। গত ২৬-২৮ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের জঙ্গী সমর্থকরা যে তা-বলীলা চালিয়েছে তা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরালো যে কোন প্রস্তুতি ছিল না তা স্পষ্ট হয়েছে ঘটনার পর। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রিপোর্ট, সরকারী উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অভিমত প্রদানের পর স্পষ্ট হয়েছে হেফাজতের এহেন তা-বলীলার নেপথ্যে রচিত হয়েছিল আরেকটি নীলনক্সা। দেশের স্বাধীনতা দিবসের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে বিরোধিতার নামে তারা আক্রমণ চালিয়েছে থানা পুলিশের ওপর, জ্বালিয়ে দিয়েছে ভূমি অফিস, এসিল্যান্ড কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা। ঘটনার পর সরকার পক্ষে সতর্ক অবস্থান নিয়ে বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খতিয়ে দেখা হয়। মোদিবিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভের নামে সরকারী ও জনগণের সম্পদ জ্বালাও পোড়াও ঘটনা কেন? এর মাধ্যমে হেফাজতীরা কী জানান দিতে চেয়েছিল? এরই মধ্যে ঘটে গেছে আরেক বিস্ময়কর ঘটনা। ধর্ম নিয়ে যারা রীতিমত বাড়াবাড়ি করে। মানুষের মাঝে উগ্রবাদ ছড়িয়ে দিতে তৎপরতা চালায় হেফাজত নেতৃবৃন্দের চরিত্রেও এর স্পষ্টতা পরিলক্ষিত। এদেরই একজন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ধরা পড়লেন নারী কেলেঙ্কারি নিয়ে। শুধু একজন নয়, এ পর্যন্ত একাধিক পরকীয়ার ঘটনায় মামুনুলের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে এসেছে। যা শুধু মামুনুল নয়, পুরো সংগঠনের ওপর কালিমা লেপন করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মূল গণমাধ্যমে মামুনুলের পরকীয়ার বিভিন্ন ঘটনা পরিষ্কার হওয়ার পর মামুনুল নিজে এবং তার ঘনিষ্ঠরা বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এসব হয়েছে হিতে বিপরীত। মামুনুলের পরকীয়ার ঘটনার সব গোমর কেবলই ফাঁস হয়েছে একের পর এক। একটিতে বন্ধুর স্ত্রীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিগঞ্জের একটি রিসোর্টে হাতেনাতে ধরা পড়ার ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার বহুগামিতা তথা একাধিক পরকীয়ালীলার চিত্র বের করতে সক্ষম হয়েছে। এখন বিষয়টি স্বচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার। এরপরও গত রবিবার হাটহাজারীর বড় মাদ্রাসায় হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের এক বৈঠকে মামুনুলের ঘটনাটিকে একান্ত তার নিজস্ব বলে আখ্যায়িত করে প্রকারান্তরে ধর্ম, সমাজ, আইনবিরোধী ঘটনাটিকে বৈধতা দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়েছে। এ বৈঠকটি নিয়ে দেশের আগ্রহী মহল আশা করেছিল এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে নিজেদের ইজ্জত রক্ষার প্রয়াস নেয়া হবে, সেখানে নেতাদের অনেকে উল্টো নতুন নতুন ফতোয়া দিয়েছেন, যা কোন মহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। শুধু অন্যান্য মহল নয়, হেফাজত অভ্যন্তরেও এ ঘটনা নিয়ে চরম বিরোধের জন্ম দিয়েছে। কারণ, হেফাজত যে স্লোগান নিয়ে এবং যে স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের অনুসারীদের মাঠে নামায় তার সঙ্গে নেতাদের কর্মকা-ে কোন মিল খুঁজে পাচ্ছে না। ২৬ থেকে ২৮ মার্চ তা-বলীলা চালানোর পর হেফাজতের পক্ষ থেকে আরও বড় কিছু করার হুঙ্কারও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যেসব ঘটনা তারা দেশজুড়ে সৃষ্টি করেছে তা কোন মহলে স্বীকৃতি পায়নি। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনা নিয়ে একের পর এক মামলা দিচ্ছে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ৭০ জন। এরমধ্যে সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাও রয়েছে। এখন শুরু হয়েছে রিমা-। রিমা-ে বের হবে এদের নীলনক্সার চিত্র। সব মিলিয়ে এখন হেফাজতের সামগ্রিক কর্মকা- চলে গেছে ব্যাকফুটে। তাদের অতীত এবং সাম্প্রতিক কর্মকা-ে বিএনপি-জামায়াত ভর করেছিল। স্বপ্ন দেখিয়েছিল অনেক। কিন্তু সে সব স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তা-বলীলার সঙ্গে যারা জড়িত এখন তারা গ্রেফতার ও আইনী মোকাবেলায় আতঙ্কে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্থানের ধংসযজ্ঞ চালানোর ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। সে অনুযায়ী অপকর্মে জড়িতদের খুঁজে খুঁজে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এদিকে, গত রবিবার হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বৈঠকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সকলেই মামুনুলের পরকীয়ার ঘটনা নিয়ে ছিলেন ক্ষুব্ধ। যদিও সংগঠনের ইজ্জত আব্রু ঢাকতে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার পথই বেছে নিয়েছেন। বলে দিলেন বিষয়টি মামুনুলের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ধর্মীয় ব্যানারের এ সংগঠনটির মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্যের চূড়ান্তবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত থেকেও তা নিয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করার বিধান ধর্মে তো নেই। এরপরও কেন তা নিয়ে রাখঢাক। এদিকে, একদিকে বাংলা নববর্ষ, অপরদিকে পবিত্র মাহে রহমান। অপরদিকে, করোনার কারণে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে টানা আরও একসপ্তাহের লকডাউন। এ লকডাউন কঠোরভাবে মানার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এ নির্দেশনার আওতায় বহু কিছুর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধের কথাটি স্পষ্ট। কিন্তু হেফাজত নেতারা রমজানে কওমি মাদ্রাসা বন্ধ করা যাবে না বলে হুঙ্কার দিয়েছে। এ হুঙ্কার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, এরা কি দেশের আইনের বাইরে কিনা। যিনি ঘোষণা দিয়েছেন তিনি হেফাজতের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমেদ শফীকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়ার প্রয়াসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পিবিআইয়ের তদন্ত রিপোর্টে তিনি হয়েছেন একনম্বর আসামি। সোমবার পিবিআই চট্টগ্রামের আদালতে তাদের তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেছে, যেখানে অভিযুক্ত করা হয়েছে ৪৩ জনকে। এ রিপোর্ট বেরিয়ে আসার পর হেফাজতের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে যারা শফী সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত তারা এখন আরেকদফা ক্ষেপেছে বর্তমান নেতৃবৃন্দের ওপর। তারা চায় আইনীভাবে এদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। আর সাংগঠনিকভাবে এদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হোক। কিন্তু নেতৃত্ব যেখানে এখনও শফীবিরোধীদের হাতে, সেক্ষেত্রে বহিষ্কার বা সাংগঠনিক কোন ব্যবস্থা নেয়া এখনও কঠিন হয়ে আছে। এরপরও দিন দিন বিভিন্ন বিষয় যতই খোলাসা হচ্ছে ততই হেফাজত নামের আকর্ষিক গজিয়ে উঠা এ সংগঠনটির রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থের কার্যক্রম ব্যাকফুটে চলে যাচ্ছে। মঙ্গলবার এ সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছেন, হেফাজত মূলত কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক একটি সংগঠন। সরকারবিরোধী বিভিন্ন মহলের উস্কানিতে এদের মাঠে নামিয়ে বহুমুখী তা-বলীলা চালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়েছে। মূলত কওমি সাধারণ ছাত্ররা সংগঠন নেতাদের আসল অভিলাষ নিয়ে কোন ধারণা রাখে না। তাদের ধর্মীয় তকমা দিয়ে উগ্রপন্থা বেছে নেয়ার পথে ঠেলে দেয়া হয়। ফলে এরা অনেকটা না বুঝে না জেনে নেতাদের নির্দেশ পালনে তৎপর থাকে। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনা এবং গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চের ঘটনাবলী তা-ই প্রমাণ করে বলে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রে মত ব্যক্ত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরোদমে তা-ব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনী অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত যারা তারা এখন প্রাণ বাঁচানোর তৎপরতায় লিপ্ত। তৌহিদী জনতার নামে কোন অপকর্মই যে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারে না হেফাজতীদের কর্মকা- সেটা নতুনভাবে প্রমাণ করল। ধারণা করা হচ্ছে বাবুনগরী সমর্থকদের গোপন ঝারিঝুরি এবং মামুনুলের মতো ভ- নেতাদের গোমর একে একে আরও ফাঁস হবে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের মাধ্যমে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সে বিষয়টি নিয়েও তৎপর রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
×