ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মুক্ত সচিব পর্যায়ের বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ বিষয়ে আলোচনা

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাঁধা দূরীকরণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে : বাণিজ্যমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১৯:০৫, ৭ মার্চ ২০২১

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাঁধা দূরীকরণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে : বাণিজ্যমন্ত্রী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাঁধা দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক সহযোগীতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রবিবার বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠক শেষে ভারতের বাণিজ্য সচিব মি. অনুপ ওয়াধানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারী প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করতে আসেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মুক্ত হবে। ইতোমধ্যে রেলপথ চালুর ফলে উভয় দেশের বাণিজ্য সহজ হয়েছে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে চলমান সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে উভয় দেশের বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ২৬ মার্চের ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে আসবেন। তাঁর এই সফরকে ঘিরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ কারণে দুদেশের সচিব পর্যায়ের এই বৈঠকেও এসব বিষয় আলোচনা করা হয়। রাজধানী ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সচিব পর্যায়ের এই বৈঠক সকাল সাড়ে ৯ টায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বৃদ্ধির আরও সুযোগ রয়েছে। জানা গেছে, বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের এবারের বৈঠকে সাপটা চুক্তির শর্তমানাসহ পাঁচ বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পাটের উপর আরোপিত এ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য এবার ভারতের কাছে জোরালো দাবি জানানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যের ক্ষেত্রে নতুন কাস্টমস রুলস প্রয়োগ না করতে ভারতকে অনুরোধ করা হয়। এর আগে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে সাফটাসহ যেসব আঞ্চলিক চুক্তির আওতায় ভারতে বাংলাদেশী পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়, সেগুলোর শর্ত মেন চলতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ট্যারিফ ও নন ট্যারিফ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সমাধান, ব্যবসা সহজীকরণে সমঝোতা স্মারক এবং বৃহৎ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিপা) করার ব্যাপারে আলোচনা এগিয়ে নেয়া এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে বিগত ৫০ বছরের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, সচিব পর্যায়ের এবারের বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য। বিশেষ করে পাট রফতানিতে এ্যান্টি ডাম্পিং আরোপের বিষয়টির সমাধানে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর ভারত সিপা চুক্তি করতে আগ্রহী। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সম্ভাব্য ও সমীক্ষা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। জানা গেছে, দীর্ঘ পাঁচ বছর আগে হঠাৎ করে ভারত বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্য রফতানির উপর এ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করে। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে এই ইস্যুতে একাধিক বৈঠক করা হলেও ভারত তা আমলে নেয়নি। বরং দেশটির অভিযোগ ছিল বাংলাদেশ ভারতের স্থানীয় বাজারের চেয়ে কম দামে পাট রফতানি করছে। এই অভিযোগের কারণ দেখিয়ে প্রতি টনে বাংলাদেশকে ৩৫১ দশমিক ৭২ ডলার পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে। এতে করে বাংলাদেশের পাট রফতানিতে মারাত্মত বিপর্যয় তৈরি হয়। দেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের দাম কমে যায়। বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যেও প্রধান ক্রেতা ভারতের এ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপের ফলে দেশের কৃষক এবং এ শিল্পখাতের সঙ্গে জড়িতরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এরপর থেকে সরকারী পর্যায়ে বহু দেনদরবার করে সমস্যা সুরাহার কোন পথ বেরিয়ে আসেনি। জানা গেছে, এ্যান্টি-ডাম্পিং আরোপ প্রত্যাহারের বিষয়টি এখন ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের। বাংলাদেশে পণ্য রফতানিতে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। সম্প্রতি ভারতের আগ্রহে বৃহৎ অংশীদারিত্বের অর্থনৈতিক চুক্তি সিপা করতে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এখন এই চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করছে উভয় দেশ। বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যেও ক্ষেত্রে নতুন কাস্টমস রুলস প্রয়োগ না করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে ঢাকা। চিঠিতে সাফটাসহ যেসব আঞ্চলিক চুক্তির আওতায় ভারতে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়, সেগুলোর শর্ত মেন চলতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এবার বাণিজ্য সচিব পর্যাযের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে। সার্ক প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেডিং এগ্রিমেন্ট (সাপটা), সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া (সাফটা) ও এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্ট (আপটা) এর আওতায় মদ ও তামাক জাতীয় ২৫টি পণ্য পণ্য বাদে সকল পণ্যে বাংলাদেশ ভারতের বাজারে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পাচ্ছে। বৃহৎ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের চুক্তি (সিপা) নিয়ে ভারতের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এবার এই চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভুটানের সঙ্গে অগ্রাধিকার মূলক বাণিজ্য চুক্তি করেছে। চলতি বছরে আরও ১১টি দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করা হতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে করা হবে সিপা চুক্তি। সম্প্রতি সচিবালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বৃদ্ধির আরও সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে উভয়দেশকে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্য চুক্তিতে এগিয়ে আসতে হবে। ট্যারিফ ও নন ট্যারিফ জনিত সমস্যাগুলো সমাধান, এছাড়া ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে ভিসা জটিলতা একটি বড় সমস্যা। সহজে ভিসা প্রাপ্তি, টেস্টিং ল্যাব স্থাপন, বর্ডার হাট স্থাপন, বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শুল্ক ও অশুল্কজনিত সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগের বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ভারতীয় প্রতিনিধিদল বৈঠকে জানিয়েছে, অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানে ভারত আন্তরিক। শীঘ্রই এসব বিষয়ের সমাধান করা হবে। বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ॥ ভারতীয় বাণিজ্য সচিবের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি বাণিজ্যমন্ত্রীর টিপু মুনশির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে দু’দেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে নতুন দ্বার খুলে যাবার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। রেলপথ চালুর ফলে উভয় দেশের বাণিজ্য সহজ হয়েছে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে চলমান সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে উভয় দেশের বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে উভয় দেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে এমন কিছু করতে, যা উভয় দেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাববে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, চলমান বর্ডারহাটগুলো উভয় দেশের মানুষের মধ্যে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। এ বর্ডার হাটের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগে নেয়া হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি বর্ডার হাট উদ্বোধন করা হবে। যে সকল পণ্যের উপর এ্যান্টি ডাম্পিং আরোপ করা আছে, আলোচনার মাধমে সেগুলোর বিষয়ে যৌক্তিক সমাধান করা হবে। টিপু মুনশি বলেন, ভারত বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ফুড প্রসেসিং এবং মটর ভেইকেল নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নে উত্তরে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সাথে পিটিএ এবং এফটিএ স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাণিজ্য সুবিধা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সাথেও বাংলাদেশ কমপ্রিহেনসিপ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সিইপিএ) স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাণিজ্য সুবিধা সৃষ্টির জন্য কাজ করছে। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ফলে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর বাংলাদেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবে না। সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রী বলেন, আসন্ন পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি বাণিজ্যমন্ত্রণারয়ের অধীন ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশ(টিসিবি) এর মাধ্যমে প্রয়োজনের দ্বিগুন পণ্য সরবরাহ করা হবে। ফলে পবিত্র রমজান মাসে কোন পণ্যের ঘাটতি হবে না এবং মূল্য বৃদ্ধি হবে না। ভারতের বাণিজ্য সচিবের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার বিক্রম দোরাই স্বামীসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×