ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাতের মুঠোয় নাটক সিনেমা- জনপ্রিয় হচ্ছে ওয়েব সিরিজ

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০২০

হাতের মুঠোয় নাটক সিনেমা- জনপ্রিয় হচ্ছে ওয়েব সিরিজ

গৌতম পাণ্ডে ॥ ‘করোনার ভয়ে বাইরে তেমন যাই না। ঘরের কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়েব সিরিজ দেখি। ইতোমধ্যে বেশকিছু ওয়েব সিরিজ দেখেছি। গল্পগুলো অসাধারণ লেগেছে। কাহিনীগুলো বেশ মজার ও আকর্ষণীয়’- বলছিলেন রাজধানীর রাজারবাগের বাসিন্দা গৃহিণী রোকসানা। বিনোদন ভুবনে ওয়েব সিরিজ এখন অতি পরিচিত নাম। চলচ্চিত্র বা নাটক নির্মাণ করে ইন্টারনেটের বিভিন্ন স্ট্রিমিং সাইটে প্রকাশ করা হয় বলে এর নামকরণ হয়েছে ওয়েব সিরিজ। আমাদের দেশে ওয়েব সিরিজের যাত্রা খুব বেশিদিনের নয়। অল্প দিনেই বেশ জায়গা দখল করে নিয়েছে এই মাধ্যমটি। সম্প্রতি টিভি নাটকের চেয়েও বেশি পরিমাণে নির্মিত হচ্ছে ওয়েব সিরিজ। ভাল বাজেট, ডিজিটাল প্লাটফর্মের দর্শক চাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয় বিবেচনা করে এসব ওয়েব সিরিজে অভিনয় করছেন জনপ্রিয় তারকারাও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচিবোধেরও পরিবর্তন আসে এটাই স্বাভাবিক। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিনোদনের মাধ্যমও পাল্টে যায়। কোন এক সময়ে নাটক দেখার একমাত্র মাধ্যম ছিল টেলিভিশন। যুগের চাহিদায় এরও পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। ইন্টারনেটের সুবাদে যে কোন স্থানে বসেই বিশ্বের নানা ভাষার নাটক-সিনেমা দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাই স্বাভাবিক কারণে বিনোদনপ্রেমীরা এখন ডিভাইস নির্ভর হয়ে পড়ছে। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইমের মতো বহু স্ট্রিমিং সাইটের দিকে বর্তমানে বেশি ঝুঁকছে বিনোদনপ্রেমী দর্শক। বাংলাদেশেও ওয়েব সিরিজের দর্শক চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। এ কারণেই সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের নির্মাতারা ওয়েব সিরিজ নির্মাণের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। নব্বইয়ের দশকে প্রথম হলিউডের প্রচলন শুরু হলেও, একুশ শতকে ইন্টারনেটের ব্যাপকতায় জনপ্রিয় হয়ে উঠে ওয়েব সিরিজ। বিভিন্ন স্ট্রিমিং সাইট খুললেই অসংখ্য ওয়েব সিরিজের দেখা মেলে। শুধু ইংরেজী নয়, বাংলা ও হিন্দি ভাষাভাষী দর্শকের কাছেও ওয়েব সিরিজ হয়ে উঠেছে অমৃতসম। সম্প্রচার সময়, বিজ্ঞাপন বিরতির বিড়ম্বনা এমনকি সেন্সরের ঝামেলা পোহাতে হয় না বলে নির্মাতারা ওয়েব সিরিজ নিয়েই আজকাল বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন। এসব কারণে দর্শকের কাছেও বিষয়টি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চাইলেই দর্শক ব্যক্তিগত মোবাইল কিম্বা কম্পিউটারে যখন খুশি দেখে নিতে পারেন। দর্শকের চাহিদা মাথায় রেখে নির্মাতা কিংবা অভিনয় শিল্পীরাও ওয়েব সিরিজে আগ্রহী হচ্ছেন বেশি। দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্প হুমকির মুখে। যার কারণে চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশক ও শিল্পীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। এগুলো থেকে উত্তরণের পথ কি? এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। অনেকের ভাষ্য নাটক, সিনেমা যদি অনলাইন প্লাটফর্মে চলে আসে, তাহলে তো দর্শকশূন্য হয়ে পড়বে সিনেমা হলো কিংবা টেলিভিশন নাটক। ‘দেশা দ্য লিডার’, ‘হিরো ৪২০’ ও ‘পাষাণ’ নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বেশ সাড়া জাগিয়ে তুলেছেন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা সৈকত নাসির। তিনি বর্তমানে ওয়েব সিরিজ নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সৈকত নাসির জনকণ্ঠকে জানান, এর আগে জ্যাজ থেকে আমার তিনটি সিনেমাই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। আমি বর্তমানে ওয়েব সিরিজের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমার এ ওয়েব সিরিজগুলো সিনেমার মতোই হবে। বর্তমানে ওয়েব সিরিজের জনপ্রিয়তা কেমন? এ প্রশ্নের উত্তরে সৈকত নাসির বলেন, বিশ্বব্যাপী এখন ওয়েব সিরিজের গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। সময়ের অভাবে দর্শক সিনেমা হলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। সময় ও অর্থ বাঁচিয়ে ঘরে বসেই পছন্দের সিনেমা বা নাটক দেখার সুযোগ পাচ্ছেন দর্শক। আমাদের তো বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। টেলিভিশনের নাটক থেকে এক প্রকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন দর্শক। ইতোমধ্যে ‘ফোন এক্স’ ও ‘ইন্দুবালা’ ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা অনন্য মামুন। অনন্য মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দর্শক ওয়েব সিরিজ নিতে শুরু করেছে। আগামীতে ওয়েব সিরিজই থাকবে। টিভি নাটকের ওপর এর কোন প্রভাব পড়বে কিনা এর জবাবে অনন্য মামুন বলেন, ওয়েব সিরিজ ও টিভি নাটক দুটোই আলাদা। টিভি নাটকে বাজেট থাকে কম, ওয়েব সিরিজে বাজেট থাকে বেশি। সব কিছু মিলে ওয়েব সিরিজের পরিসর অনেক বড় হচ্ছে। স্টোরি চেঞ্জ হচ্ছে, টেকনলোজি ও ইউজিং সবই বেড়ে যাচ্ছে। এটাকে কোনভাবে আপনি টিভি নাটক হিসেবে তুলনা করতে পারবেন না. এটাতো বিশ্বব্যাপী। কোন মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পছন্দ করে আবার কেউ হাতের ফোনে দেখেন, সুতরাং ব্যাপারটা ভিন্ন। ‘ইন্দুবালা’ নামের একটি ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা সাদিয়া পারভীন পপি। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ওয়েব কন্টেন্টের যুগ শুরু হয়ে গেছে। সব দেশেই তো হচ্ছে। ভাল কিছু হলে তো কাজ করতে আপত্তি নেই। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রও অনেক ডেভেলপ হচ্ছে। মুম্বাই, কলকাতাসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক আগে থেকে ওয়েব সিরিজ চালু হয়ে গিয়েছে এবং জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? চলচ্চিত্র বা টিভি নাটকের ওপর ওয়েব সিরিজের প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, অলরেডি চলচ্চিত্রের ওপর প্রভাব পড়েই আছে। দেশে এক সময় দুইশ থেকে আড়াইশ সিনেমা রিলিজ হতো, এখন ত্রিশটাও হয় না। সিনেমা হলের সংখ্যাও কমে গেছে। ভাল কাজের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ক্ষতি কি? বিপাশা কবির অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘পাষাণ’। প্রথম চলচ্চিত্র ছিল সায়মন তারিকের ‘গুণ্ডামি’। এরপর তাকে নায়িকা হিসেবে আরও দেখা গেছে শাহেদ চৌধুরীর ‘আড়াল’, সোহেল বাবুর ‘বাজে ছেলে দ্য লোফার’ এবং সায়মন তারিকের ‘ক্রাইম রোড’ চলচ্চিত্রে। বর্তমানে তিনি ওয়েব সিরিজের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। জায়েদ রেজওয়ান পরিচালিত ‘আঘাত’ নামের ওয়েব সিরিজে তিনি জুলিয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এছাড়া তরুণ নির্মাতা অনন্য মামুনের ‘জার্নি’ ওয়েব সিরিজে একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। বিপাশা কবির জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আঘাত’ আমার প্রথম অভিনীত ওয়েব সিরিজ। সত্যি বলতে কী এখন তো ওয়েব সিরিজ দর্শক খুব দেখছেন। যে কারণে অনেক আগ্রহ নিয়ে এতে কাজ করছি। তিনি বলেন, আগে তো মানুষ ফিল্ম শুধু হলে গিয়ে দেখত। এখন ইন্টারনেটের ওপর বেশি ঝোঁকের কারণে হাতের মুঠোয় সব কিছু পেয়ে যায়। এ কারণেই ওয়েব সিরিজটি বেশি আলোচনায় এসেছে। এটাকে সমালোচনার দিকে না নেয়াই ভাল। আমি বলতে চাই দর্শক গ্রহণ করছে বলেই নির্মাতারা এটা তৈরি করছেন, তা না হলে টাকা খরচ করে কেনই বা এটা বানাবেন। ওয়েব সিরিজের ধরন ফিল্মের মতো। ছোট পর্দা আর বড় পর্দার পার্থক্য তো অবশ্যই আছে। পরিচালক সমিতির সভাপতি সেন্সর বোর্ডের সদস্য মুশফিকুর রহমান গুলজার জনকণ্ঠকে বলেন, ওয়েব সিরিজ চলচ্চিত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এমনভাবে এখনও সামনে আসে নাই, সীমিতভাবে এসেছে। আমাদের সিনেমা যেভাবে সেন্সর দেয়া হয়, ওইটুকুর মধ্যে যদি সীমাবদ্ধ থকে তাহলে চলচ্চিত্রের কোন ক্ষতি হবে না। যদি অশ্লীলতা কিংবা ভায়োলেন্স বা রাজনৈতিক বক্তব্য, যেগুলো আমাদের ক্ষতির কারণ সেগুলোর দিকে সতর্ক থাকা যায় তাহলে কোন অসুবিধে নেই, কারণ সারা বিশ্বে এটা হচ্ছে। যেহেতু ওয়েব সিরিজগুলো ডিজিটাল আইনে চলে। যদি মনে হয় ওয়েব সিরিজগুলো ডিজিটাল আইনবিরোধী কিছু করছে তখন মামলা হতে পারে। যে তরুণরা ওয়েব সিরিজ তৈরি করছে তারা যাতে নিরুৎসাহিত না হয়, এজন্য কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করা হবে। আর যদি সেরকম কোন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে ডিজিটাল আইনে মামলা অথবা পরবর্তীতে সেন্সরের আওতায় আনা হবে।
×