ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী সন্দেহে এক বাংলাদেশী গ্রেফতার ॥ এক সপ্তাহে ১৫ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে

ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজার

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১ ডিসেম্বর ২০২০

ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজার

ফিরোজ মান্না ॥ জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশী এক কর্মীকে গ্রেফতারের পর পুলিশ বাংলাদেশী কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৫ বাংলাদেশী কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাদের বিরুদ্ধেও জঙ্গী তৎপরতার অভিযোগ তোলা হয়েছে। ৪ বছর আগে সিঙ্গাপুরে ৮ জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছিল দেশটির পুলিশ। এবার আহমেদ ফয়সল নামের এক বাংলাদেশী নির্মাণ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২৬ বছর বয়সের বাংলাদেশী এই যুবক ২০১৭ সাল থেকে দেশটিতে কাজ করছেন। সিরিয়ায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ে শামিল হতেই তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট দিতেন। তার বিশ্বাস ছিল, সিরিয়ায় যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ দিলে শহীদের মর্যাদা পাবেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরের বাজারটি স্থিতিশীল ছিল। সিঙ্গাপুরের বাজার বাংলাদেশের জন্য কোনদিনই বন্ধ হয়নি। কয়েক বছর ধরে দেশটিতে বাংলাদেশী কিছু কর্মীর বিতর্কিত ঘটনায় বাজারটি নষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে ২০১৬ সালে ৮ জনকে গ্রেফতার করে দেশটির পুলিশ। এবার আরও একজনকে জঙ্গী সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে বাজারটি বাংলাদেশের জন্য দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশী এক কর্মী জঙ্গী সন্দেহে গ্রেফতার হওয়ার পর দেশটি থেকে গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৫ বাংলাদেশী কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকার সন্দেহ রয়েছে। জঙ্গী তৎপরতায় কারণে একটি ভাল বাজার নষ্ট হোক, এটা আমরা চাই না। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সিঙ্গাপুর সরকারকে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। বিএমইটির সার্ভার চেক করে দেখা হচ্ছে, গত কয়েক বছরে কারা কারা সিঙ্গাপুরে গেছেন। তাদের পারিবারিক ও নিজের অবস্থান কি ছিল তা খুঁজে বের করে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করা হবে। কাজটি চলমান রয়েছে। কোন জঙ্গীর কারণে সিঙ্গাপুরের মতো বাজার নষ্ট হতে দেয়া হবে না। সূত্র জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনের আওতায় আহমেদ ফয়সলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় এ বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নিরাপত্তা অভিযান জোরদার করা হয়। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ এ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ৩৭ জনের সন্দেহভাজন কর্মকাণ্ড নিয়ে তদন্ত চালায়। সন্দেহভাজন এসব ব্যক্তির মধ্যে বিদেশী ২৩ জন এবং স্থানীয় ১৪ জন। বাংলাদেশের নাগরিক রয়েছে ১৫ জন ও মালয়েশিয়ার ১ জনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। দেশে ফেরত পাঠানো অধিকাংশই নির্মাণকর্মী। সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে সিঙ্গাপুরে জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার সাত বিদেশীর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের আহমেদ ফয়সল। তাঁকে ২ নবেম্বর গ্রেফতার করা হয়। সিরিয়ায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ে শামিল হতে সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর। তাঁর বিশ্বাস, সিরিয়ায় যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ দিলে শহীদের মর্যাদা পাবেন। আহমেদ ফয়সল নজরদারি এড়াতে ছদ্মনামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। এসব এ্যাকাউন্ট থেকে তিনি সশস্ত্র লড়াই আর সংঘাতের বিভিন্ন রকম পোস্ট দিয়েছেন। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে সিরিয়ায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল জঙ্গী সংগঠন হায়াত তাহরীর আল শামের (এইচটিএস) প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এইচটিএসের তহবিলে চাঁদাও দিয়েছেন ফয়সল। এ ছাড়া তিনি আলকায়েদা ও সোমালিয়ার আলশাবাবের মতো জঙ্গীগোষ্ঠীর সমর্থনে বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিলেন। তিনি দেশে ফিরে জঙ্গী হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের ছুরি কিনেছিলেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম সূত্র জানিয়েছে, সিঙ্গাপুর থেকে ১৫ বাংলাদেশী নাগরিক ফেরত পাঠানোর বিষয়টি সম্পর্কে তাঁরা জানেন না। তবে গ্রেফতার ফয়সল সম্পর্কে তাঁরা খোঁজখবর নেবেন। এই নামে একজন জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, সে সম্পর্কে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন আগেই। তখন থেকেই খোঁজখবর নেয়া হচ্ছিল। এদিকে ২০১৬ সালের মে মাসে সিঙ্গাপুরে জঙ্গী সন্দেহে আট বাংলাদেশীকে আটক করা হয়েছিল। যাঁরা দেশে ফিরে গিয়ে গুপ্ত হত্যাসহ সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করছিলেন বলে দাবি করেছে ওই দেশের সরকার। সেই সময় সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছিল। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনে আট বাংলাদেশীকে আটক করা হয়েছে। এসব ব্যক্তি একটি গোপন দলের সদস্য। এ দলের শীর্ষ ব্যক্তি ৩১ বছর বয়সী নির্মাণ কর্মী মিজানুর রহমান। তিনি গত মার্চে ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ (আইএসবি) নামে সিঙ্গাপুরে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাকি সাতজনকে দলে নেন। সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গ্রেফতার ৮ বাংলাদেশীর ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। এঁরা হলেন মিজানুর রহমান (৩১), লিয়াকত আলী মামুন (২৯), সোহাগ ইব্রাহিম (২৭), রুবেল মিয়া (২৬), দৌলতুজ্জামান (৩৪), শরিফুল ইসলাম (২৭), মোঃ জাবেদ কায়সার হাজি নুরুল ইসলাম সওদাগর (৩০) ও ইসমাইল হাওলাদার সোহেল (২৯)। তাঁঁরা সবাই নির্মাণশিল্পের ও নৌশিল্পের ‘ওয়ার্ক পারমিটধারী’ কর্মী। সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আটককৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে ‘আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু’ হিসেবে বাংলাদেশের কিছু সরকারী ও সামরিক কর্মকর্তার নামের তালিকা, অস্ত্র ব্যবহার ও বোমা তৈরির পদ্ধতি সংক্রান্ত দলিলপত্র এবং উগ্রপন্থী বইপত্র পাওয়া গেছে। তাঁরা সিরিয়া ও ইরাকে সক্রিয় জঙ্গী সংগঠন আইএসে যোগ দিতে চান। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া কঠিন বলেই তাঁরা বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে সহিংস উপায়ে সরকার উৎখাতের মাধ্যমে একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দেশটিকে আইএসের স্বঘোষিত খিলাফতের অধীনে নেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। আইএসবি সিঙ্গাপুরের নিরাপত্তার জন্য একটি হুমকি। কারণ এটি আইএসকে (ইসলামিক স্টেট) সহায়তা দিচ্ছে এবং বিদেশে সহিংসতা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। তাঁদের বিষয়ে সিঙ্গাপুরের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচীর এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশের অনেক কর্মী জঙ্গী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে জেলে আটক আছেন। তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলো খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছে তারা জঙ্গীবাদের আদর্শের লোক। ফলে এই কর্মীদের বিষয়ে হাইকমিশন বা দূতাবাস কোন ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি।
×