ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

পুরান ঢাকায় অবাধে তৈরি হচ্ছে নামী ব্র্যান্ডের নকল পণ্য

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ১৫ নভেম্বর ২০২০

পুরান ঢাকায় অবাধে তৈরি হচ্ছে নামী ব্র্যান্ডের নকল পণ্য

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ পুরান ঢাকার অলিগলিতে অবাধে তৈরি হচ্ছে নামীদামী ব্র্যান্ডের নকল পণ্য। এই তালিকা থেকে বাদ যায়নি শিশুদের ব্যবহার্য প্রসাধন সামগ্রীও। নকল প্রসাধন সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার, চকবাজার, উদু রোর্ড, ইসলামবাগ, বড়কাটারা, ছোটকাটারা, রহমতগঞ্জ লালবাগ, ইসলামবাগ, ইমামগঞ্জ, নবাবপুর, কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অলিতে-গলিতে প্রায় ১০ হাজার বাসাবাড়ির নিচে এবং খুপরি ঘরে রাসায়নিক গোডাউন ও নকল পণ্যের কারখানা অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। পুরান ঢাকায় একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মতো মানববিধ্বংসী দুর্ঘটনা ঘটার পরও এখান থেকে ভেজাল সাম্রাজ্য সমূলে উৎপাটনের উদ্যোগ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কারণ প্রভাবশালীদের দাপটে এ বিষয়ে বড় আকারের ব্যবস্থা নিতে পারছে না প্রশাসন। মূলত বিষয়টি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। এর ফলে বছরের পর বছর ধরে এই ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ ব্যবসাকে ঐতিহ্য হিসেবেই বেছে নিয়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এসব নকল প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে অনেকেই এখন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছে। একই কারণে এখানে আবারও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। সূত্র জানায়, গত চার বছরে পুরান ঢাকার প্রায় ২০০ নকল পণ্যের কারখানা বন্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এমনকি সাড়ে ৮ কোটি টাকারও বেশি জরিমানা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, পুরনো ঢাকার পাইকারি বাজার চকবাজার, মৌলভীবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ, ইমামগঞ্জ ও নবাবপুরে অবাধে শিশুদের ব্যবহার্য প্রসাধন পণ্য নকল তৈরি হচ্ছে। আর শিশুদের এসব নকল বিদেশী অয়েল, শ্যাম্পু, পাউডারসহ নানা পণ্য প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। এসব ভেজাল পণ্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণও অনেক সময় বুঝতে পারেন না অভিভাবকরা। তাদের অভিযোগ, অন্তত শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে হলেও পুরান ঢাকার এই ভেজাল সাম্রাজ্য সমূলে উৎপাটনের উদ্যোগ নেয়ার সময় এসেছে। বছরের পর বছর এই অবৈধ ব্যবসাকে ঐতিহ্য হিসেবেই নিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এর ফলে মাসের পর মাস অভিযানে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড দিয়েও কাজ হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, নকল ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। গত সপ্তাহে পুরনো ঢাকার পাইকারি বাজারে নকল শিশু পণ্যের দোকানে ও কারখানা অভিযান চালায় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় এসব শিশু পণ্যের কারখানা বিভিন্ন বিদেশী ব্র্যান্ডের নকল শিশু প্রসাধন তৈরির অপরাধে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এক বছর করে দুইজনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। সেখানে জনসন এ্যান্ড জনসনের আদলে তৈরি মোড়কে বেবি লোশন, বেবি শ্যাম্পু, পাউডার, ইউনিলিভারের পন্ডস, ফেয়ার এন্ড লাভলিসহ ২৮ ধরনের নকল প্রসাধন সামগ্রী জব্দ করা হয়। র‌্যাব সদর দফতরের তথ্য বলছে, দেশে ২০১৬ সাল থেকে ৩১ অক্টোবর ২০২০ সাল পর্যন্ত ভেজাল পণ্য সংক্রান্ত ৯১৭টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রায় ৭০ ভাগ অভিযান হয়েছে রাজধানীতে। যার অর্ধেকের বেশি হয়েছে পুরান ঢাকায়। এই কয়েক বছরে চকবাজার, মৌলভীবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ, ইমামগঞ্জ ও নবাবপুর মিলে প্রায় ২০০টি নকল পণ্যের কারখানা বন্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানা করা হয়েছে সাড়ে ৮ কোটি টাকারও বেশি। যেখানে চার বছরে সারাদেশে র‌্যাবের অভিযানে মোট জরিমানা করা হয়েছে ১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯৬ হাজার ৩৩৯ টাকা। র‌্যাবের সাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামের মতোই ভয়ংকর এ নকল পণ্য ও অবৈধ কারখানাগুলো। এদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে, কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছে কিন্তু জামিনে বের হয়ে আবার তারা আগের ব্যবসায় ফিরে যায়। অভিযান র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পরিত্যক্ত মোড়ক ও কৌটাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে তারা। তাছাড়া অবৈধ পথে ভারত, চীন, মালয়েশিয়া থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে ব্র্যান্ডের প্যাকেট, কৌটা আর বাহারি মোড়কে ভেজাল প্রসাধনী ভরে বিক্রি করা হচ্ছে আসল দামে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজারসহ আশপাশের কয়েকটি পাইকারি বাজার নকল পণ্যের বাজার অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এটি ওপেন সিক্রেট। এমনকি এদের একটি বিশাল ব্যবসায়ী সংগঠন রয়েছে। কেউ অভিযান চালালে তারা দোকান বন্ধ করে দেয়। আবারও এই সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এমনকি কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বললে নেমে আসে নির্যাতন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, অজ্ঞাত কারণে এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তবে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় এই সংগঠনের আড়ালে একটি ভেজাল পণ্যের বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বছরের পর বছর এরা ভেজাল শিশু খাদ্য ও পণ্য থেকে শুরু করে নামকরা পণ্য নকল করে বিক্রি করা হচ্ছে। পরে তার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আর প্রতিমাসে এসব প্রভাবশালী মহল ও স্থানীয় প্রশাসন কোটি টাকার মাসোহারা পাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এই কারণে বন্ধ হচ্ছে না নকল পণ্যের কারখানা। এখান থেকে নিরাপদে নকল পণ্য পাইকারি বাজারে চলে যাচ্ছে। বিপরীতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক ভোক্তারা। র‌্যাব সাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের সারওয়ার আলমের মতে, পুরান ঢাকা বিশেষ করে চকবাজার-মিটফোর্ড এলাকার অলিগলিতে নকল প্রসাধনী, নকল ওষুধ, নকল ইলেকট্রিক সরঞ্জাম, অবৈধ পলিথিনের কারখানা আবার এগুলোতেই কাঁচামাল হিসেবে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বসতবাড়িতেই এসব রাসায়নিকের গুদাম। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এসব অবৈধ কারখানাগুলো চলছে স্থানীয় প্রভাবশালী ও বাড়ির মালিকের ছত্রছায়ায়। প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে এই ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বাড়ির মালিকদের দ্বিগুণ ভাড়া দেন। তাই অভিযানে বাড়ির মালিকদেরও জবাবদিহিতায় আনা হয়। র‌্যাব গোয়েন্দা ও কনজ্যুমারস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্যানুযায়ী, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় চার শতাধিক নকল প্রসাধন সামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। যার মধ্যে পুরান ঢাকাতেই আছে সিংহভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মৌলভীবাজারের হাজী হাবিবুল্লাহ মার্কেটের সব দোকানে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রসাধনীতে ভরপুর। সাবান, শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, ক্রিম, লোশন, পাউডার, শ্যাম্পু, তেলসহ ৭০-৮০ ধরনের নকল প্রসাধনী পাওয়া যায়। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিটি দোকানে প্রায় ৫০টি আইটেম আছে। সব বাইরের। এখান থেকে দিনে ৪০-৫০ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি হয়। সূত্রগুলো জানায়, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা চকবাজারে নকল প্রসাধনী তৈরির চারটি কারখানা ও ছয়টি গোডাউন সিলগালা করে দেয়া হয়। কাউকে আটক না করলেও বিক্রির অভিযোগে আট দোকান মালিককে সাড়ে ৪৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বউ সাজ’ও ছিল ওই তালিকায়। চকবাজার ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানের ফলে সমিতির পক্ষ থেকে নকল পণ্য উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের কড়াভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু টাকার লোভে তারা থামছে না। একবার বন্ধ করা হলে ধাপে ধাপে টাকা দিয়ে নতুন করে আবার কারখানা খুলে বসে। নকল পণ্যের বাজার অনেক বড়। মাস গেলে এদের মধ্যে হাতবদল হয় প্রায় এক শ’ কোটি টাকা। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) পরিচালক সাজ্জাদুল বারী জানান, আমাদের আওতাধীন ১৮১টি বাধ্যতামূলক পণ্যের বিষয়েই আমরা মান যাচাই করি। নকল ও ভেজাল কসমেটিক্সের পাশাপাশি ভেজাল খাদ্য নিয়েও বিএসটিআই নিয়মিত কাজ করছে। পুলিশের লালবাগ বিভাগ জানায়, নকল প্রসাধনী তৈরিতে যেসব ব্যবসায়ী জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিএসটিআইর সহায়তায় পুলিশ অভিযান চালায়। পুরান ঢাকায় নকল পণ্যের খোঁজ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
×