ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল নিষেধাজ্ঞার সময় কড়াকড়ি ছিল প্রশাসনের

উৎসবের আমেজে ইলিশ ধরতে নদীতে জেলেরা

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ৫ নভেম্বর ২০২০

উৎসবের আমেজে ইলিশ ধরতে নদীতে জেলেরা

ওয়াজেদ হীরা ॥ ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠল। বুধবার মধ্যরাতে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় জেলেরাও জাল ও মাছ ধরার নৌকা, সরঞ্জাম নিয়ে ইলিশ ধরতে ফিরল নদীতে। মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০২০ উপলক্ষে গত ১৪ অক্টোবর থেকে ২২ দিন পর ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল যা মধ্যরাতে শেষ হয়। নিষেধাজ্ঞা যারা অমান্য করার চেষ্টা করেছে সরকার তাদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে ছিল। এবার কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জালসহ অন্যান্য জব্দকৃত জালের আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকার বেশি। কড়া নজরদারির কারণে নিষেধাজ্ঞাকালীন সাফল্য এসেছে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা। আর জেলেরা দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা শেষে ইলিশ শিকারে যেতে পেরে উৎফুল। জেলে পল্লীগুলোতেও এখন উৎসবের আমেজ। কেননা, জাল আর মাছ ধরার ওপর নির্ভর করে বাঁচে জেলেরা। এবারও ইলিশ নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোতে কড়াকড়ি আরোপ করেছিল প্রশাসন। এবারই প্রথম হেলিকপ্টার দিয়েও টহল দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যদিও সরকারের কড়া নজরদারির মধ্যে কোথাও কোথাও প্রসাশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরেছেন জেলেরা। তবে সরকারী সুবিধা পাওয়া জেলেরা বলছেন মাছ না ধরলে নিজেদের লাভের কথাই। বড় আকারের মাছ পাওয়া যায়। মৎস্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের আহ্বায়ক ও মৎস্য অধিদফতরের ইলিশ শাখার কর্মকর্তা মাসুদ আরা মমি জনকণ্ঠকে বলেন, এবার অভিযান হয়েছে বেশ বড় আকারে। অনেক কড়া নজরদারি ছিল। বিভিন্ন ধরনের যে জাল আটক হয়েছে তার মূল্য ২০০ কোটি টাকার বেশি; যা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি। এ বছর মা ইলিশ রক্ষায় অভিযান নিয়ে মৎস্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের ইলিশ নিষেধাজ্ঞার শেষদিন সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে অভিযান, মামলা, আটকের তথ্য। শেষদিনের হিসাব ব্যতীত ২১ দিনে মোট ১৮ হাজার ৮৪৭টি অভিযান হয়েছে। মোবাইল কোর্ট হয়েছে ২৪৯৩ টি। এই অভিযানে ৪১.৬৫ মেট্রিক টন ইলিশ জব্দ করা হয়েছে। কারেন্ট জাল আটক করা হয় ১২৪১ লাখ মিটার। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে ৬ হাজার ৪২৬টি মামলা এবং ৮২ লাখ ১৩ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। জেল হয়েছে ৫২১৩ জনের। এছাড়া অবৈধ উপকরণ নিলাম করা হয়েছে ১৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকার। জানা গেছে, কারেন্ট জাল, বেহুন্দি জালসহ অন্যান্য জব্দকৃত জালের আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০০ কোটি ৩৫ লাখ ৭ হাজার টাকা। এ বছর রাজধানীতে ইলিশ কেনাবেচা মনিটরিং করতে ৮টি টিম কাজ করে। এই টিমের মাধ্যমে শুধু রাজধানী ঢাকাতে প্রায় ৭ লাখ ৭৪ হাজার টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। মোবাইল কোর্ট হয়েছে ৭১ টি, মামলা হয়েছে ৫৬টি। ৩.৯৪ মে.টন ইলিশ এবং ৪.৮৮ মেট্রিক টন অন্যান্য মাছ জব্দ করা হয় রাজধানীর অভিযানে। এদিকে, পদ্মা, মেঘনা পাড়ের একাধিক জেলে জানিয়েছেনÑ দীর্ঘদিন অনেকটাই অলসতার মধ্যে থাকলেও অপেক্ষা ছিল কবে উঠবে নিষেধাজ্ঞা। সন্ধ্যা থেকেই নৌকা, জালসহ প্রস্তুত হয় জেলেরা নদীতে যাওয়ার জন্য। চাঁদপুরের জেলে হাবিব মিয়া বলেন, সরকারী সহায়তা পেলেও বেকার দিনগুলো কষ্টের হয়। এখন আবার নদীতে যাচ্ছি। মাছ ধরতে পারব, এটা ভেবেই মনে শান্তি পাচ্ছি। মুন্সীগঞ্জের জেলে ইয়কুব বলেন, মাছ ধরেই খাই, এটাই আমাদের পেশা। অনেকেই নিষেধ সময়ে লুকিয়ে মাছ ধরে ঠিকই, তবে সেটা আরও ঝুঁকির। এখন আমরা মাছ ধরব। আমাদের পরিবারও খুশি। চাঁদপুরের জেলে জমির বলেন, ২২ দিন অবসর সময়ে ঋণ করে টাকা নিয়ে জাল, সুতা ও নৌকার অন্য সামগ্রী কিনে ঠিক করেছি। এই সময়ে যে সাহায্য তাতে কিছু না হলেও আমাদের অপেক্ষাই করতে হয়। তবুও ভাল, কেউ কেউ এই সহায়তা পাচ্ছে। ইলিশ শিকারে যাচ্ছি। এটাই এখন আমাদের কাছে আনন্দের। বেশি মাছ পেলে আরও ভাল লাগে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, প্রায় ৫ লাখ লোক ইলিশ আহরণের সঙ্গে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক ইলিশ পরিবহন, বিক্রি, জাল ও নৌকা তৈরি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রফতানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইতোমধ্যে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ সময়ের আগেই দেশের ইলিশসমৃদ্ধ ৩৬ জেলার ১৫৩ উপজেলায় মোট ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৪২টি জেলে পরিবারকে ২০ কেজি করে মোট ১০ হাজার ৫৬৭ মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। মন্ত্রী বলেছেন, সামুদ্রিক জলসীমায় ৬৫ দিন মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধকালে সমুদ্র উপকূলীয় ৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৮৯টি জেলে পরিবারকে মোট ৩৬ হাজার ৩৬৪ মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া গত মার্চ-এপ্রিলে জাটকা ধরা থেকে বিরত রাখতে দেশের ২০ জেলার ৯৬টি উপজেলায় ২৪ হাজার ১০৩ টন ভিজিএফ চাল বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এ সময় দেশের মোট ৩ লাখ ১ হাজার ২৮৮টি জেলে পরিবার প্রতিমাসে ৪০ কেজি হারে দুই মাস এ সহায়তা পান। ২০১৬ সাল থেকে মা ইলিশের প্রজনন সময়ে এই সহায়তা দেয়া শুরু হয়। সে সময় ১৪ জেলার ৭৬ উপজেলায় ৩ লাখ ৫৬ হাজার জেলেকে সহায়তা দেয়া হয়েছে। এবার ৩৬ জেলার ১৫২ উপজেলায় ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৪২ জেলে সহায়তা পাচ্ছে। এর জন্য বরাদ্দ ১০ হাজার ৫৬৬.৮৮ মেট্রিক টন চাল। ইলিশ শাখার কর্মকর্তা কন্ট্রোল রুমের আহ্বায়ক মাসুদ আরা মমি বলেন, আমাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হচ্ছে। আর এই সহায়তা জেলেদের বেঁচে থাকার জন্য; যেহেতু কাজ নেই, তাই। তবে এর আগে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ৩২ হাজার জেলের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও জানান। স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, বুধবার রাত ১২টার পর ইলিশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ শিকারে নেমে পড়েছেন জেলেরা। ফলে আজ বৃহস্পতিবার থেকে বাজারে মিলতে থাকবে সামুদ্রিক এই মাছ। এতে মৎস্যজীবীদের মাঝে ফিরে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য। বুধবার পুরোদিনই কর্ণফুলীর ঘাটে ঘাটে ছিল মৎস্যজীবীদের সাগরযাত্রার প্রস্তুতি। নিষিদ্ধের ২২টি দিন তাদের জন্য ছিল অনেক কষ্টের। তবে সরকারের পক্ষ থেকে চালসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা ছিল। প্রতি জেলের জন্য ২০ কেজি করে চাল দিয়েছে সরকার। এর আগে ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা ছিল মাছ ধরার ওপর, যা শেষ হয় ২৩ জুলাই। ওই সময়ে প্রতি জেলেকে প্রথম দফায় ৬৫ কেজি, দ্বিতীয় দফায় ৩০ কেজি চাল বরাদ্দ দেয়া হয় সরকারীভাবে। সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, সাগরে মাছ শিকার করে প্রায় ৩৪ হাজার নৌযান। তবে ইঞ্জিনচালিত নৌকার লাইসেন্স রয়েছে ৯ হাজারের মতো। মাছের প্রজনন বৃদ্ধি এবং বড় মাছ পাওয়ার জন্য বছরে কয়েকদফায় সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখা হয়। এর সুফলও পাচ্ছে দেশ। নিষিদ্ধের সময়টুকুতে যেন মাছ শিকার করা না যায় সে জন্য কোস্টগার্ডের সহায়তায় নজরদারি বজায় রাখা হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীর ফিশারিঘাট এলাকায় বুধবার দেখা যায় মাছ ব্যবসায়ীদের পদচারণা। কারণ, আজ বৃহস্পতিবার থেকে জমে উঠতে যাচ্ছে মাছের ব্যবসা। সকল ধরনের মাছই পাওয়া যাবে; তবে এ সময়ে ইলিশ ধরা পড়বে বেশি। সামুদ্রিক মাছের সরবরাহ বাড়ায় বাজারে প্রভাব পড়বে। নিষিদ্ধের এ সময়ে মিঠাপানির মাছের দাম বেড়ে গিয়েছিল। আজ থেকে মাছ ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা এবং মা ইলিশ সুরক্ষাকালীন কড়াকড়ি আরোপ করার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। সেই সঙ্গে বাজারে বড় আকারের ইলিশও।
×