ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় চার নেতা কারাস্মৃতি জাদুঘর দিচ্ছে সেই উত্তর

দেশপ্রেম কী রাজনীতি আসলে কেন

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ৪ নভেম্বর ২০২০

দেশপ্রেম কী রাজনীতি আসলে কেন

মোরসালিন মিজান ॥ এখন ‘দেশ’ ‘দেশ’ করার কত লোক! কিন্তু দেশ আসলে কী? কাকে বলে দেশপ্রেম? রাজনীতিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, নেতা হিসেবে থাকতে হবে সামনের কাতারে, ঠিক কেন এ অভিপ্রায়? কার স্বার্থে রাজনীতি? জরুরী আরও অনেক প্রশ্ন। উত্তর? না, সমকালের কাছে নেই। এজন্য একবারটি ঘুরে আসা চাই ‘জাতীয় চার নেতা কারাস্মৃতি জাদুঘর’ থেকে। কয়েক বছর আগে মোটামুটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই অবস্থিত জাতীয় চার নেতা কারাস্মৃতি জাদুঘর। এখানেই ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এর বহুকাল পর ২০১০ সালের ৮ মে যাত্রা শুরু করে জাদুঘর হিসেবে। সচল কারাগারের একেবারেই অভ্যন্তরে হওয়ায় জাদুঘরটি তখন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব ছিল না। বর্তমানে এ সমস্যা নেই। কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু যুতসই পরিকল্পনার অভাবেই হয়ত আজ পর্যন্ত চার নেতা স্মৃতি জাদুঘর খুলে দেয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে কক্ষটি ঘুরে দেখার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন মানুষ। বিশেষ করে আজকের রাজনীতিবিদদের জন্য এটি খুলে দেয়া খুব জরুরী। রক্ত¯্রােতে ভেসে যাওয়া কারাকক্ষ দেখলে হয়ত তারা দেশপ্রেম, আদর্শের রাজনীতি ও নেতার প্রতি আপসহীন আনুগত্যের শিক্ষাটা এখান থেকে পেতে পারতেন। যে নেতার প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হচ্ছে তিনি আর কেউ নন, শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়। প্রায় একই সময়ে অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে গ্রেফতার করা হয় তাঁর যোগ্য বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে। বন্দী অবস্থায় পুরনো কারাগারের ‘নিউ জেলে’ তাঁদের হত্যা করা হয়। তিন কক্ষবিশিষ্ট একতলা ভবনটিই এখন জাদুঘর। কক্ষগুলো নেতাদের ব্যবহৃত স্মৃতি নিদর্শন দিয়ে সাজিয়ে নেয়া হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পুরনো প্রাঙ্গণে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে সোজা এবং মোটামুটি প্রশস্ত একটি রাস্তা। রাস্তাটি ধরে কয়েক মিনিট হাঁটার পর বাঁ পাশে অপেক্ষাকৃত সরু আরেকটি পথ চোখ পড়ে। এটি ধরে সামান্য এগিয়ে গেলেই জাতীয় চার নেতার ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্য। পাশাপাশি স্থাপন করা আবক্ষমূর্তি দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। একটা কেমন যেন নীরব নিস্তব্ধ কান্নামাখা পরিবেশ। ঠিক পেছনের দেয়ালে লেখা- জাতীয় চার নেতা কারাস্মৃতি জাদুঘর। জাদুঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মানবিক মানুষ মাত্রই একটা ঝাঁকুনি খাবেন। বুকটা ধক করে ওঠবে। নতুন রং করা ভবন। যতটা সম্ভব সুন্দর করা হয়েছে। এরপরও বেদনার রং ঢাকা পড়ে না। প্রথম যে কক্ষটি চোখে পড়ে সেটি ১ নম্বর কক্ষ হিসেবে পরিচিত। কক্ষটিতে মূলত থাকতেন দুই নেতা। একজন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অন্যজন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং একে সফল পরিণতি দান করা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ঘটনার দিন বাকি দুই নেতাকে এখানে একত্রিত করে ব্রাশফায়ার করে নপুংশক খুনী দল। দেশপ্রেমের রাজনীতি ও দেশপ্রেমিক নেতার মৃত্যু হয় না। শহীদ স্মৃতি কক্ষটির নাম তাই ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বারান্দা থেকে দেখতে হয়। তখন চোখে পড়ে একটি নাম ফলক। ফলকের ইটগুলোতে রক্তের প্রতীকী রং লাল। মাঝে সাদা শ্বেতপাথওে লেখা চার মৃত্যুঞ্জয়ীর নাম এবং সংক্ষিপ্ত পরিচয়। এই ফলক থেকে চোখ তুলে সামনে তাকালে লোহার গ্রিল। বাইরে দাঁড়িয়ে গুলি ছুড়েছিল ঘাতকরা। কতটা বিদীর্ণ হয়েছিল বুক, সেই প্রমাণ এখনও দিচ্ছে লোহার শিকগুলো। একাধিক শিকে খোড়লের সৃষ্টি হয়েছে। লাল রং দিয়ে খোড়লগুলো বিশেষ চিহ্নিত কওে দেয়া হয়েছে। দেখে গা শিউরে ওঠে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কক্ষের অভ্যন্তওে চোখ রাখলে দেখা যায়, ছোট চিকন চৌকি। এত ছোট আর চিকন যে, শোয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। গ্লাসশোকেসে মুড়িয়ে রাখা চৌকির পাশে কাঠের হাতাওয়ালা চেয়ার। ছোট্ট টেবিল। কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আসবাবগুলো সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্যবহার করতেন। তাদের ব্যবহৃত চৌকি চেয়ার টেবিল এখন নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী। স্মৃতি নিদর্শন। দ্বিতীয় কক্ষটিও দেখতে প্রায় অভিন্ন। একইরকম চৌকি ও টেবিল চেয়ার পাতা। এখানে রাখা হয়েছিল এএইচএম কামারুজ্জামানকে। এম মনসুর আলীকে রাখা হয়েছিল তৃতীয় কক্ষে। তাঁদের ব্যবহৃত চৌকি এবং টেবিল চেয়ারও কলঙ্কজনক ইতিহাসের স্মারক হয়ে আছে। তবে জাদুঘরের কোথাও জেলহত্যার ইতিহাসটি লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়নি। বর্ণনা করার কেউ তেমন নেই। তাই শরণাপন্ন হতে হয় চার নেতার সঙ্গে সে সময় জেলে থাকা জীবিত বন্দীদের। তাদেরই একজন সাইদুর রহমান প্যাটেলের। তৃতীয় কক্ষটিতে একই সময় বন্দী ছিলেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। এখন বয়স অনেক। কিন্তু দুঃসহ স্মৃতি ভুলেননি। তিনি জানান, প্রথম কক্ষে শুধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন না, মোট ৮ জন নেতাকর্মীকে রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় কক্ষে আরেক জাতীয় নেতা কামারুজ্জামান ছাড়াও ছিলেন ৯ থেকে ১০ জনের মতো রাজবন্দী। তৃতীয় কক্ষে এম মনসুর আলীসহ সবচেয়ে বেশি ১৭ জন বাস করতেন। প্যাটেল বলেন, খুনী ডালিমসহ কয়েকজন আগেই রেকি করে গিয়েছিল নিউ জেল। আমরা তখন থেকেই শঙ্কা করছিলাম। হত্যাকা-ের রাতটা ভয়ঙ্কর এবং বিভীষিকাময় ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, রাত ৩টা ১৭ মিনিটে পাগলা ঘণ্টি বেজে ওঠে। একটি কাসার ঘণ্টি ছিল, সেটি বাজতে থাকে। কারারক্ষীরাও অনবতর হুইসেল বাজাতে থাকে। এভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির এক পর্যায়ে চার জাতীয় নেতাকে প্রথম কক্ষটিতে একত্রিত করা হয়। এক পর্যায়ে কানে আসতে থাকে গুলির শব্দ। তখনই মনে হচ্ছিল, সব শেষ। তা-ই হয়েছিল। ভোবেলা সামান্য আলো ফুটতেই আমরা দেখি জেলের সামনের ড্রেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে সবাই চিৎকার করে ওঠি- লিডারদের কেউ আর বেঁচে নেই। লিডারদের মেরে ফেলা হয়েছে। প্যাটেল ছিলেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর কক্ষে। কাছ থেকে নেতাকে দেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, হত্যা করার কিছুক্ষণ আগে কারারক্ষীরা তাঁকে নিয়ে যায়। হাফ হাতা হালকা গেঞ্জির ওপর পাঞ্জাবি পরে তিনি চলে তাদের সঙ্গে। আমি তখন বলেছিলাম, লিডার ওরা বোধহয় কোন কাগজপত্রে সাইন টাইন করাতে চাইবে। কিন্তু মনসুর আলী মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই গিয়েছিলেন বলে মনে হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও কথা হয় প্যাটেলের। নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, হত্যার আগের রাতে তাজউদ্দীন আহমদ স্বপ্নে বঙ্গবন্ধু দেখেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যেতে এসেছিলেন বলে জানান। দুঃস্বপ্নই সত্য হয় মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর। ঘাতকদের নির্মমতার বর্ণনা দিয়ে প্যাটেল বলেন, এম মনসুর আলী তখনও শহীদ হননি। পান করার জন্য পানি চাচ্ছিলেন। কারারক্ষীরা পানি দেয়নি। বরং কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে অস্ত্রধারীদের খবর দেয়। তারা ফিরে এসে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মনসুর আলীর মৃত্যু নিশ্চিত করে। চার নেতার প্রত্যেকের শরীরেই বেয়নেট চার্জ করা হয়। ‘এনেছিলে সাথে করি মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান...। অমূল্য এই দানে আজ উজ্জ্বল কারা স্মৃতি জাদুঘর। পরবর্তিতে সেই মর্মন্তুদ স্মৃতি তুলে ধরে তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদ লিখেছেন, ‘কতক্ষণ ওভাবে অশ্রুপ্লাবনে সিক্ত হয়েছিলাম জানি না। পানির ঝাপটায় দুঃখ ধুয়ে যায় না, তারপরও বৃথা আশায় বেসিন খুলে সমানে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিতে থাকলাম। ঘরের বাইওে বেরিয়ে দেখি আম্মাকে ড্রইংরুমের সোফাতে বসানো হয়েছে। এলোমেলো চুলে ঘেরা আম্মার চোখে-মুখে কী নিদারুণ হাহাকার! এক পর্যায়ে আম্মা ডুকরে কেঁদে বললেন, এই সোনার মানুষটাকে ওরা কীভাবে মারল! কীভাবে মারল সে উত্তর এখন সকলের জানা। তবে কোন শক্তি বলে এমন সোনার মানুষেরা আপোস করলেন না, কেন আগেই নিহত হওয়া নেত শেখ মুজিবের আদর্শে অটুট থেকে জীবন বিলিয়ে দিলেন, তা আবিষ্কার করার এখনও বাকি। জাতীয় চার নেতাকে কেন এভাবে মরতে হলো? বাঁচার কোন পথ কি ছিল না? হয়তো ছিল। সে সময়ের ইতিহাস বলছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খুনীরা আওয়ামী লীগের তখনকার সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সমর্থন আদায়ের নানা চেষ্টা করেছে। জনসমর্থনকে প্রভাবিত করতে পারেন এমন এমপি মন্ত্রীদের দলে টানতে প্রলোভন দেখিয়েছে। কেউ কেউ ঠিকই বিক্রি হয়ে গেছেন। জাতীয় চার নেতা ছিলেন নিজেদের অবস্থানে অটল। খুনীরা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে আবারও পশ্চাদপদ পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে কাজ করছিল। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা থেকে সরে এসে চলমান প্রতিবিপ্লবে সামান্য সায় দিলেই চুকেবুকে যেত সব। প্রিয় নেতা ‘মুজিব ভাইয়ের’ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে নতুন জীবন পেতেন তারা। কিন্তু এমন বিশ^াসঘাতকের জীবনকে চার নেতা চাননি। ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও দেশের প্রতি প্রেম নেতার প্রতি আনুগত্য অটুট ছিল তাদের। এই নেতারা বেঁচে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের নীতি আর মুজিবের আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, নিশ্চিত হয়েই বঙ্গবন্ধুর পর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় বটে। হারিয়ে যাননি চার নেতা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলীকে শ্রদ্ধা ভালবাসার আসনে ঠাঁই দিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। কারাস্মৃতি জাদুঘর জয়গান গাইছে তাদের। ঘোষণা দিয়ে বলছে, তারা মৃত্যুঞ্জয়ী। এমন মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার শিক্ষা কি আজকের নেতারা নিতে চান? তাহলে ঘুরে আসুন জাদুঘরটি। তাদের জন্য অন্তত খুলে দেয়া হোক জাতীয় চার নেতা কারাস্মৃতি জাদুঘর।
×