ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্য বাড়বে মধ্যপ্রাচ্যে ॥ করোনার ধাক্কা সামলানোর উদ্যোগ

প্রকাশিত: ২২:৪০, ২৩ আগস্ট ২০২০

বাণিজ্য বাড়বে মধ্যপ্রাচ্যে ॥ করোনার ধাক্কা সামলানোর উদ্যোগ

এম শাহজাহান ॥ করোনা পরবর্তী অর্থনীতি চাঙ্গা করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং উজবেকিস্তানকে টার্গেট করে রফতানি বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ আকর্ষণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। দেশগুলোর প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ দ্রুত দেশে আনার চেষ্টা চলছে। এজন্য কাস্টমস সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতগণকে ডেকে বাংলাদেশ থেকে পণ্যসামগ্রী রফতানি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত স্বার্থ রক্ষায় ৩১ বিষয়ে সহযোগিতা করতে সৌদি আরব আশ্বাস দিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এতে বাংলাদেশের রফতানি আরও বাড়বে, আসবে বিনিয়োগ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে করোনার ধাক্কা সামলানো যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশী পণ্যের ব্যাপক চাহিদার কারণেই এই বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে হালাল ফুড, ওষুধ, পোশাক, প্লাস্টিক ও পাট পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী পণ্য ব্যবহার করছেন। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও বাংলাদেশী পণ্য নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কাস্টমস সংক্রান্ত নানা জটিলতার মুখে চাহিদা থাকার পরও পণ্য রফতানি তেমন বাড়ছে না। এ লক্ষ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়াতে কাজ শুরু করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য সংক্রান্ত শতাধিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ। করোনা পরিস্থিতির কারণে স্থবির হয়ে পড়ছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম। জীবিকার প্রয়োজনে গত রোজার ঈদের আগে লকডাউন তুলে নিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে দেয় বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে আসতে শুরু করেছে বিদেশী বিনিয়োগ। প্রধান প্রধান রফতানি পণ্যের ক্রয়াদেশ বাড়ায় আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। রেমিটেন্সের জোয়ারে বেড়েছে রিজার্ভ। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে আমদানি-রফতানির মতো বাণিজ্যিক কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চলতি মাসে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে ‘এগ্রিমেন্ট বিটুইন দ্য গবর্মেন্ট অব দ্য কিংডম অব সৌদি এরাবিয়া এ্যান্ড দ্য গবর্মেন্ট অব পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ অন কো-অপারেশন এ্যান্ড মিউচুয়াল এ্যাসিস্ট্যান্স ইন কাস্টমস ম্যাটারস’ চুক্তি। এই অনুমোদনের ফলে সৌদির সঙ্গে কাস্টমস সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় চুক্তি করতে পারবে বাংলাদেশ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের অনেক যোগাযোগ রয়েছে। সেই যোগাযোগের ক্ষেত্রে কাস্টমস একটি বড় ফ্যাক্টর। সেজন্য সৌদি আরবের শুল্ক সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান, শুল্ক ফাঁকি রোধে সহযোগিতা করা। কিভাবে বাণিজ্য সহজ করা যায়, যদি কাস্টমস ডিউটিগুলো আরও সহজ করা যায় তাহলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে। জানা গেছে, কাস্টমস সংক্রান্ত এই চুক্তিটি করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরও বাড়বে। দুই দেশের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ সুসংহত হবে। দুই দেশ অনলাইনে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারবে। পণ্যের অবৈধ বাণিজ্য ও চোরাচালান প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রাখবে। এছাড়া এই চুক্তি হলে সৌদি আরবের সঙ্গে দুই দেশের অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য ও অন্যান্য স্বার্থ রক্ষা করা যাবে। গোয়েন্দা কার্যক্রমের বিষয়ে দুই দেশ পরস্পরকে সাহায্য করতে পারবে। দেশের কাস্টম বিভাগের দক্ষতা বাড়াতেও সৌদি আরব এই চুক্তির আওতায় সহযোগিতা দিতে পারবে। তিন দেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বাণিজ্য বাড়ানোর নির্দেশ ॥ তিন দেশ সৌদি আরব, কুয়েত ও উজবেকিস্তানে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূতদের ডেকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি রফতানি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি এই তিন দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতগণ তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। ওই সময় রাষ্ট্রদূতরা জানান, করোনা পরবর্তী অর্থনীতি উত্তরণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া তাদের প্রতিশ্রুত বিনিযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে পণ্য নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশের সঙ্গে বড় অঙ্কের যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে তা দূর করা সম্ভব। ওই সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ পরবর্তী রফতানি বাণিজ্যের সুযোগ গ্রহণ করতে দূতাবাসগুলোকে আরও দ্রুত কাজ করা উচিত। এজন্য বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতগণকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। সৌদি আরব, কুয়েত এবং উজবেকিস্তান বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র। এখানে বাংলাদেশী পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাণিজ্যের সুযোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধি করা সম্ভব। রাষ্ট্রদূতগণকে বাণিজ্য প্রসারে অবদান রাখতে হবে। কোভিড-১৯ এর কারণে পরিবর্তিত বিশ^ বাণিজ্যে বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এসেছে, এ সুযোগ দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে হবে। ইতোমধ্যে রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ^ মন্দা অর্থনীতির মধ্যেও গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রফতানি আয় ২৩ দশমিক ০৬ মিলিয়ন বেশি হয়েছে। রাষ্ট্রদূতগণকে গতানুগতিক কাজের বাইরে গিয়ে দেশের রফতানি বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে হবে বলে জানান তিনি। ওই সময় সৌদি আরবে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারি, কুয়েতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আসিক এবং উজবেকিস্তানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। বাংলাদেশ সরকার দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। এগুলো বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরতে কাজ করবে দূতাবাসগুলো। উজবেকিস্তান বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উজবেকিস্তানও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। উভয় দেশ বাণিজ্য জটিলতা দূর করতে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ৩১ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত ॥ মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। সৌদি আরবের সার ছাড়া বাংলাদেশের কৃষি খাত চলে না। অন্যদিকে সৌদি আরবে লাখ লাখ বাংলাদেশী কাজ করে দেশের জন্য রেমিটেন্স নিয়ে আসছেন। গত কয়েক বছর ধরে দেশটি বাংলাদেশের বিদ্যুত, জ্বালানি, অবকাঠামো, সার্ভিস, টেলিযোগাযোগ, চিকিৎসা এবং পর্যটন খাতে বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত কয়েক ডজন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে সবকিছু এখন থমকে আছে। তবে করোনা পরবর্তী অর্থনীতি উত্তরণে সৌদি আরব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে বলে মনে করছে সরকার। আর এ কারণে সৌদি আরবের সঙ্গে কাস্টমস সংক্রান্ত একটি চুক্তির খসড়ায় অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এছাড়া বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার লক্ষ্যে গঠিত যৌথ কমিশনের ১৩তম সভায় দু’দেশের স্বার্থ রক্ষায় ৩১ বিষয়ে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ-সৌদি আরব। কয়েক মাস আগে যৌথ কমিশনের সভা হয় বাংলাদেশে। পরবর্তীতে টেকনিক্যাল সভা শীঘ্রই ডাকা হবে। সভায় সৌদি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলো অংশগ্রহণ করে এবং তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শীঘ্রই বড় ধরনের বিনিযোগ আসবে সৌদি আরব থেকে। এরইমধ্যে ১৮০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টের বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের পক্ষে স্বাক্ষর করেন দলনেতা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মনোয়ার আহমেদ এবং সৌদি প্রতিনিধি দলের নেতা সে দেশের শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মাহির আবদুল রহমান গাসিম। সৌদির এ্যাকোয়া পাওয়ারের সঙ্গে ১৮০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য চুক্তি হয়েছে। এছাড়া, বিদেশ, অভ্যন্তরীণ ও বিচার বিভাগীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই পাসপোর্ট, ওয়ার্কিং ভিসা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ভ্রমণের নথি জারি করার বিষয়ে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। এছাড়া সৌদি পক্ষ জনশক্তি সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমি (বিএফএসএ) এবং প্রিন্স সৌদ আল ফয়সাল ইনস্টিটিউশন ফর ডিপ্লোমেটিক স্টাডিজ (পিএসএফআইডিএস) সমঝোতা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করেছে। প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে সম্মত হয়েছে। দু’দেশই মাদক নিয়ন্ত্রণ, জালিয়াতি এবং জালিয়াতির অপরাধের ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করতে আরও সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে এবং উভয় দেশ শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে নতুন তথ্য হালনাগাদ করবে। বৈঠকে সৌদি পক্ষ সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এবং বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে সহযোগিতা জোরদারের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উভয় পক্ষ সৌদি রফতানি কর্মসূচীর (এসইপি) বাংলাদেশী ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের উপকারভোগীদের অর্থায়নের সুবিধার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছে। এ বিষয়ে যৌথ অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়। সৌদি চেম্বারের কাউন্সিলের অধীনে সৌদি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলো আরামকো, আল-বাওয়ানি, আল জোমিয়া, ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন রেড সি গেট ওয়ে টার্মিনাল, বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছে।
×