ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাওড়ের জীবন

প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে টিকে থাকার সংগ্রাম

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ২২ জুলাই ২০২০

প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে টিকে থাকার সংগ্রাম

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ধূসর জলরাশি। কয়েক কিলোমিটার পানিপথ পাড়ি দেয়া শেষে জেগে ওঠে দ্বীপের মতো গ্রাম। কয়েকটি বাড়ি মিলে গ্রাম বা আটি। ঘিঞ্জি বসতি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ছোট ছোট আধডোবা হিজল আর করচ ঘেরা বাড়িগুলোও যেন পানিতে ভাসছে! বাড়িসহ মাটি রক্ষার মূল কাজটিই করছে চারপাশ ঘিরে থাকা গাছগুলো। এসব গাছ বছরজুড়ে যেন বন্যা আর ঝড় থেকে পরম মমতা দিয়ে বাড়িগুলোকে সযতনে আগলে রাখে। সত্যি তাই। ঘরবাড়ির কাছাকাছি চিত্র দেখে সত্যিই ভয় পাওয়ার মতো অবস্থা। প্রতিটি বাড়ির চারপাশ ঘিরে থৈ থৈ পানি আর পানি। কোন ঘরের ভেতরেও প্রবেশ করেছে ঢলের পানি। বৃষ্টিতে বাড়তি পানি উঁকি দিচ্ছে চৌকি পর্যন্ত, আর সেখানেই ছোট্ট একটি মাটির চুলাতে রান্নাবান্না। বাঁচার অন্যতম অবলম্বন ধান-চাল আগলে রাখার চেষ্টা প্রতিটি পরিবারের। প্রয়োজনীয় সবকিছু নিরাপদ স্থানে রেখেই একটু আধটু কখনও চোখ লাগে, নইলে নির্ঘুম কাটে রাত। ইতোমধ্যে সর্বনাশা পানিতে ভেসে গেছে গোলাঘর বা বসতঘর। টং তুলে গবাদিপশুগুলোকে রক্ষার চেষ্টা। সদ্য ইরি মৌসুম শেষ হলেও বেশিরভাগ বাড়িতে এখন খড় নেই। পানিতে ছয় মাসের জন্য তলিয়েছে ঘাস। তাই এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে কেনা বা এমনিতেই শুকনো খড় এনে গরু আর ছাগলগুলোকে বাঁচানোর সংগ্রাম দিনভর। এরমধ্যে বাড়তি চাপ হলো পানি থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখা। এমনিতেই তো, প্রতি বর্ষায় শিশুদের পড়াশোনা শিকেয় ওঠে। এরমধ্যে আবার করোনার প্রভাবে মার্চ থেকেই বন্ধ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে প্রজন্মের আলোকিত হয়ে বেড়ে ওঠার প্রতিবন্ধকতা যেন পদে পদে। এর মধ্যে বাতাসে প্রতিটি ছোট বড় ঢেউ শব্দ তুলে বারবার প্রকৃতির অবস্থান জানান দিয়ে যায়। আকাশের রং কখনও ভয় দেখায়, কখনও মিষ্টি রোদ পানি কমার আশ^াসে দিন শেষে মিলায়। কাছের দৃষ্টি যেন সায় দেয়, যে কোন সময় ভেসে যেতে পারে আধাভাসা বাড়িগুলো! বেশি ভাটির ঘরগুলো তলিয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এরপরও নিজেদের রক্ষায় চেষ্টার কমতি নেই মানুষের। কলাগাছ বা বন দিয়ে ঘরে পানি ফেরানোর চেষ্টা। ঘর ঘেঁষে সযতনে আগলে রাখা হয় চলাচলের একমাত্র অবলম্বন ছোট্ট নৌকাটি। তাও দু’জনের বেশি চলা ঝুঁকিপূর্ণ। বিপদ এলে বাদ বাকি পরিবারের সদস্যের কি হবে...। না। হয়ত কিছুই হবে না। এভাবেই সংগ্রামী হয়ে ওঠেছেন হাওড়ের প্রতিটি মানুষ। প্রকৃতির সঙ্গে যাদের বছরজুড়েই চলে সংগ্রাম। টিকে থাকার লড়াই। বাড়তি পানির কারণে অনেকে বাড়ি ছেড়ে উঠেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠান এখন ব্যবহার করা হচ্ছে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে। তবে যারা আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন, তারা নিজেদের খরচাতেই চলছেন। তাদের অপেক্ষা মাত্র পানি কমার খবরের। কখন ঘর থেকে পানি নেমে আঙ্গিনায় আসবে। এমন সুখবর মেলা মাত্রই বাড়ির পথে ছুটবেন সবাই। তবে বৃষ্টি আসা মানেই আকাশের রঙে মন অন্ধকার হয়ে যায়...। এখন প্রতিদিন তাই হচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে বাড়ছে পানি, ফলে আশ্রয় নেয়া স্থানটিও পানিকবলিত হওয়ায় আশঙ্কা। বলছি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার হাওড় অঞ্চলের গল্প। সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে সুখাইড় রাজাপুর (দক্ষিণ) ইউনিয়ন। এই থানা এলাকায় ১০টি ইউনিয়ন রয়েছে। জনপদজুড়ে এখন পানি আর পানি। ঘর থেকে পা বাড়ালেই জল। এ অবস্থায় পানির মধ্যে থাকা প্রতিটি পরিবারের মানুষ যুগের পর যুগ প্রকৃতির সঙ্গে রীতিমতো সংগ্রাম করে টিকে আছেন। ফেলে আসা সময়গুলো তাদের মানসিকভাবে আরও শক্তি ও সাহস জোগায়। বেঁচে থাকায় অনুপ্রেরণ০া দেয়। বর্ষায় নাও আর হেমন্তে পাও। একথা অনেক পুরনো হলেও, এখনও ভাটি বাংলার মানুষের মুখে মুখে। অর্থাৎ প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় ভাটি অঞ্চল থাকে পানিতে নিমজ্জিত। আর শুকনো মৌসুমে হেঁটে চলতে হয়। সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে সরাসরি ধর্মপাশা উপজেলায় এখন পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ নেই। আর বর্ষা মৌসুমে একমাত্র ভরসাই নৌযান। শুকনো মৌসুমে সদর উপজেলায় কিছু অঞ্চলে ছোট ছোট যানবাহন চললেও কিছু এলাকা আছে যেখানে হাঁটা ছাড়া বিকল্প নেই। এখানকার মানুষের বাঁচার মূল উৎস কৃষি অর্থনীতি। বোরো মৌসুম অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। বর্ষা শেষে পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ধান লাগানোর ব্যস্ততা। ঝড় আর শিলা বৃষ্টির অনিশ্চয়তা কাটিয়ে সবশেষে ভয় থাকে ঢলের পানির। বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চল ঘিরে আছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। যেখানে প্রায় প্রতি বছর আগাম বৃষ্টিপাত শুরু হয়। যখন ভাটি অঞ্চলে ধান কাটার প্রস্তুতি চলে। রেওয়াজ আছে প্রতি তিন বছরে একবার বানের পানিতে ডুবে ধান, ডুবে জনপদ। কিন্তু গত ইরি-বোরো মৌসুমে আগাম ঢলের পূর্বাভাস দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত অনেকটা নির্বিঘেœই ঘরে উঠেছে সোনালি ফসল। তাই বর্ষায় বন্যার ধকল শুরু হলেও মনে প্রশান্তি অনেকের। ঘরে ধান চাল থাকা মানেই এ অঞ্চলের মানুষের প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকার বড় রকমের অনুপ্রেরণা। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার আয়তন ৫৩১ বর্গ কিলোমিটার। ১০টি ইউনিয়নে রয়েছে ৩১৯টি গ্রাম। নির্বাচনী এলাকা সুনামগঞ্জ-১। জনসংখ্যা এক লাখ ৯৭ হাজারে বেশি। পাকা রাস্তা সাত কিলোমিটার, কাঁচা সড়ক ৩৫৮ কিলোমিটারের বেশি। কৃষি জমির পরিমাণ ১৫ হাজার ৭৭ একর, অকৃষি জমি ৩৭ হাজার একরের বেশি। আদর্শ গ্রাম দুটি, জলমহাল আছে দেড় শতাধিক। বিদ্যুতায়িত গ্রাম ১৫টি। ধর্মপাশা আর মধ্যনগর নিয়ে ধর্মপাশা উপজেলা। ১৯৪২ সালে ধর্মপাশা থানার যাত্রা শুরু হয়। ২৪টি নদ-নদী প্রবাহিত হয়েছে ধর্মপাশার ওপর দিয়ে। থানা এলাকার চারপাশজুড়ে ছোটবড় অনেকগুলো হাওড় রয়েছে। টাঙ্গুয়ার ও শনির হাওড়ের কিছু অংশ এ এলাকায় পড়েছে। এর বাইরে টগার হাওড়, ধারাম, ধানকুনিয়া, সোনামড়ল, ধনুয়া, গসকা হাওড় উল্লেখযোগ্য। বাউয়ার বিল, শিয়ালদিঘা বিলসহ বেশ কয়েকটি হাওড়সম বিল রয়েছে ধর্মপাশাজুড়ে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ী ঢলে হাওড়-নদী-বিল-ডোবা-মাঠ সবকিছু একাকার হয়ে যায়। বৃষ্টি বেশি হলে যা বাড়তি বন্যায় রূপ নেয়। পানিতে তলিয়ে যায় পথ-ঘাট আর বসতি। এ সময় হাওড়বাসীকে সবচেয়ে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। তখন দ্বীপের মতো মাথা জাগিয়ে থাকে প্রতিটি বাড়ি। দূর-দূরান্ত থেকে হাওড় শেষে এসব বাড়ি ঘর বসতির জানান দেয়। তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চলাচল করা। নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সপ্তাহে একদিন ধর্মপাশা বা মোহনগঞ্জ হাটবার থাকে। ট্রলারে এসে প্রয়োজনীয় হাট বাজার নেন সুখাইড়ের মানুষ। তবে প্রতিদিনই গ্রাম থেকে ট্রলার আসে একটি থেকে দুটি। বিশেষ প্রয়োজনে রিজার্ভ ট্রলার ছাড়া দূরপথে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাও ইচ্ছেমত মেলানো কঠিন। সন্ধ্যার পর তো নৌযান পাওয়া একেবারেই সোনার হরিণের মতো। ইউনিয়নে রয়েছে একমাত্র ঠাকুরবাড়ি। এলাকায় পরিচিত ঠাকুর আটি হিসেবে। এখানে মাত্র চারটি পরিবারের বসবাস। এক সময়ের বিশাল ঐতিহ্যের এই বাড়িটি এখন নামমাত্র টিকে আছে। ঐতিহ্য সবকিছু ইতিহাস। দালান কোঠা জরাজীর্ণ। ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে সময় অসময়। ধর্মপাশার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ির পাশেই এ গ্রাম। এ বাড়ির সজল ভট্টাচার্য জানান, এ বছর কৃষকরা ভালভাবে ধান উঠাতে পারলেও পানি বাড়তি। অতি বৃষ্টির কারণে বন্যা হয়েছে। বাড়ির আঙ্গিনা পর্যন্ত এবার পানি উঠেছে। প্রতি বছর বাড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে কমছে বসতি জমি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রাতে জরুরী রোগী পরিবহন। যদিও প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করেই এ অঞ্চলের মানুষ টিকে আছে। বলা যায় প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট সবাই। কারণ সারাবছর আমাদের লড়াই প্রকৃতির সঙ্গে। কিন্তু কখনও মহা বিপদ সামনে আসে না। ছোট ছোট বিপদ আর সুখ নিয়েই আমাদের জীবন। নাপিত আটির বাসিন্দা বাদল জানালেন, বেশি বন্যা হলে উঠান ছাপিয়ে ঘরের ভেতর পর্যন্ত পানি আসে। এবার অন্য বারের তুলনায় পানির চাপ অনেক বেশি। পানিতে বাড়ি ভাঙ্গে। ঘর ডুবে যাওয়ায় অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ঘর থেকে বের হওয়া মানেই নৌকা। এ বাড়ি ও বাড়ি গেলেও নৌকা ছাড়া পথ নেই। তাই বাড়ি বাড়ি কম বেশি চলার জন্য নৌকা রয়েছে। এ গ্রামের পাশের কুইচকা আটি, থইলকা আটি, বাসাবাড়ি, মিলনপুর, দৌলতপুর, সুখাইড়, সুখাইড় বাজার, উলাসখালী, নয়াহাটিসহ আশপাশের সবকটি গ্রামের চিত্র একই রকম। সুখাইড় বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় দুটিতেই এখন বানভাসি মানুষের আশ্রয় কেন্দ্র। প্রতিটি কক্ষে আছেন একাধিক পরিবার। বাজারের পাশেই নদী। বর্ষায় নদী আর হাওড়ের পানি মিলে একাকার। পানির ধাক্কা লেগেছে বাজারেও। কিছু দোকান খোলা, কিছু পানি ওঠায় বন্ধ রয়েছে। বাজার এলাকার বাসিন্দা বিমল জানান, আমাদের সংগ্রামী জীবন। বর্ষা কিংবা হেমন্ত সব সময় আমাদের যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হয়। হেমন্তে ঝড়ের ভয়। ফসল নষ্টের আশঙ্কায় রাত দিন চিন্তিত থাকতে হয়। বারবার ঈশ^রের কাছে প্রার্থনা করি কষ্টের ফসল যেন ঘরে উঠে। আমার সন্তানের মুখে বছরজুড়ে হাসির উৎস এই ফসল। যদি ঢল বা বন্যায় ফসল ডুবে তবে কষ্টের শেষ নেই। কারণ সুদে টাকা এনে এলাকার বেশিরভাগ মানুষ ফসল করে থাকেন। আর জীবন জীবিকার মূল উৎস ফসল। তিনি জানান, বর্ষায় অনেকে মাছ ধরেন। কেউ মাছ বিক্রি করেন। বন্যার সঙ্গে আমাদের যেন মিতালি। প্রতিবার অতি বৃষ্টি আর অতি পানির সঙ্গে টিকে থাকার যুদ্ধ করতে হয়। বর্ষায় আরেকটি সমস্যা হলো শুকনো লাকড়ি না থাকা। যারা প্রস্তুতি হিসেবে গোবর শুকনো করে রেখেছিলেন তারা এখন জ¦ালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। পানি কমলে হাওড় থেকে গাছপালা কেটে আনা যায়। যা বর্ষায় সম্ভব হয় না। লেক্কুল মিয়া জানালেন, ‘নাও বাইলে বেশি টাকা অয় না। চার ধারে পানি আর পানি। মানুষ ঘর থাইক্যাই বাইরে আইনন্যা। কোন রকম চলি’। স্থানীয় বাসিন্দা প্রতাব ভট্টাচার্য জানালেন, প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের যুগের পর যুগ কেটে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আপদ-বিপদ এখন গা সয়ে গেছে। এসব কিছুকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের প্রতিদিন কাটে বলা যায়। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চিকিৎসাসেবা। ইচ্ছা করলেই সহজে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এখনও গ্রামে সনাতনি পদ্ধতিতে বেশিরভাগ শিশুর জন্ম হয়। আর শিশুদের পড়াশোনার ভাল কোন পরিবেশ নেই। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের সন্তানরা সুনামগঞ্জ শহরে পড়াশোনা করছে।
×