ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুপার হিরোর জন্য ভালবাসা

প্রকাশিত: ২২:১৫, ২১ জুন ২০২০

সুপার হিরোর জন্য ভালবাসা

মোরসালিন মিজান ॥ বাবা একটু কঠিন। একটু মেজাজী। মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে না। বরং গম্ভীর দেখায়। বাইরে থেকে বাবা দেখতে, হ্যাঁ, এমনই হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন। কিন্তু ভেতরে তার আদরের নদী। সন্তানের জন্য, বুঝতে দেন না বটে, গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করেন তিনি। বাবা বটবৃক্ষের ছায়া। সবচেয়ে বড় আশ্রয়। বাবা সন্তানের চোখে সুপার হিরো। আজ সেই হিরোর ঋণ স্মরণ করার, স্বীকার করার বিশেষ দিন। বিশ্ব বাবা দিবস। দিবসটি বাবার নামে হলেও, মূলত উদ্যাপন করে সন্তানরা। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার এই দিবসটি উদ্যাপন করা হয়। আজ সেই দিন। কেউ আজ বাবাকে মুখ ফুটে বলবে ‘ভালবাসি।’ কেউ মনে মনে। ঘরোয়া উদ্যাপনের পাশাপাশি কেক কাটা উপহার প্রদানের মতো আনুষ্ঠানিকতাও চোখে পড়বে আজ। আর সবচেয়ে বেশি সরব হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বাবা হয়তো জানবেনও না, ফেসবুকে টুইটারে সন্তান কত আবেগী ভাষায় তার কথা লিখেছে, কত আদরে ভালবাসায় স্মরণ করছে তাকে। আর যারা নিজেরাও বাবা হয়েছেন তারা ফিরে যাবেন শৈশবে। পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বাবাকে আবিষ্কারের চেষ্টা করবেন। সদ্য বা অনেক আগে প্রয়াত বাবার কথা ভেবে নীরবে চোখ মুছবেন অনেক সন্তান। বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়...। এই দেখা আর হবে না। নিজের শিশু সন্তানকে বুকে টেনে নিয়ে কষ্ট ভোলার চেষ্টা করবেন তারা। মা সন্তানের কাছে যতটা সহজ, যত কাছের, বাবা ততটা নন। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ঢোকা বাবার শরীর থাকে ক্লান্ত। চোয়াল শক্ত হয়ে থাকে। বাবার সঙ্গে কথা বলতে হয় মেপে। সামান্য ভুলচুক হলেই বকা খাওয়ার ভয়। তবে চারপাশে দেয়াল তুলে রাখা এই বাবাকে কোন না কোনদিন ঠিক চিনে ফেলে সন্তান। তখন পিতার পদযুগলের কাছে মাথানত হয়ে আসে। জলে ভিজে যায় চোখ। বাবা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার। সন্তানের সকল বায়নাই থাকে মায়ের কাছে। এটা চাই। ওটা দাও। মা এসব আবেদন নিবেদন শোনেন বটে। বাস্তবায়ন করেন বাবা। দিন-রাত পরিশ্রম। খাটুনি। কিন্তু নিজের জন্য নয়। সন্তানের ভবিষ্যত গড়ে দেয়াই লক্ষ্য। বাবা নিজে ভাল খেয়ে বা নতুন জামা গায়ে দিয়ে সুখী হন না। সন্তানের খুশিতেই তার খুশি। বাবাদের ভেঙ্গে পড়তে নেই। কাঁদতে মানা। কারণ বাবা কাঁদলে বাবা ভেঙ্গে পড়লে সন্তানদের আর আশা থাকে না কোন। কবির ভাষায় : ‘ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো,/ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!’ কবি আবুল হাসানের সেই ঝিনুকটিই যেন বাবা। সব কষ্ট একা বুকে বয়ে বেড়ান। সন্তানকে বুঝতে দেন না। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’র কথাই যদি ধরা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবিতে আমরা খুঁজে পাই অসাধারণ এক বাবাকে। জার্মান সেনারা শিশুপুত্রসহ পিতাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে বাবার ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। কিন্তু ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ছেলেকে এতটুকু আঁচ করতে দেন না তিনি। বরং ছেলের খুশি ধরে রাখতে বলেন, এখানে একটি খেলা চলছে। যে বেশি পয়েন্ট পাবে তাকে সত্যিকারের একটি ট্যাঙ্ক উপহার দেয়া হবে। বাবা ছেলেকে বোঝান, সে যদি মায়ের কাছে যেতে চায়, খিদে পেলে খাওয়ার জন্য কান্না করে, আর ঘরে লক্ষ্মী ছেলের মতো লুকিয়ে না থাকে তাহলে পয়েন্ট কাটা যাবে। শিশুপুত্র পয়েন্ট হারাতে চায় না। সে বাবার সব কথা মেনে চলে। অথচ বাবা জানেন, জার্মান সেনারা তাকে হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে। হত্যার শিকার হন বাবা। কিন্তু কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের আতঙ্ক একদমই ছুঁতে পারে না সন্তানকে। এই হলো বাবা। স্নেহবৎসল পিতা সম্রাট বাবরের কথাও কারও অজানা নয়। এ-ও আরেক ইতিহাস। পুত্র হুমায়ুন অসুস্থ। কোন চিকিৎসাতেই কাজ হচ্ছে না। জীবনের শঙ্কা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় অসহায় পিতা সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইলেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এর কিছুদিন পরই হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। আর সম্রাট বাবর অসুস্থ হয়ে বিছানা নিলেন। অচিরেই মৃত্যু হল তার। কবির ভাষায় : মরিয়া বাবর অমর হইয়াছে, নাহি তার কোনও ক্ষয়,/পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়...। আজও পৃথিবীর অসংখ্য বাবা সন্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। তাদের ঋণ কোন সন্তানের পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। তবুও ফাদার্স ডে তে জন্মদাতা পিতার প্রতি সন্তানেরা তাদের বুকে জমানো ভালবাসা উজার করে দেয়। বাবারাও আপ্লুত হন। আজও হবেন। জানা যায়, ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গীর্জায় সর্বপ্রথম বাবা দিবস উদ্যাপিত হয়। পাশাপাশি সনোরা স্মার্ট ডড নামের ওয়াশিংটনের এক ভদ্র মহিলার মাথাতেও বাবা দিবসের চিন্তা আসে। ১৯০৯ সালে ভার্জিনিয়ার বাবা দিবসের কথা তিনি জানতেন না। ডড এই ধারণা পান গীর্জার এক পুরোহিতের বক্তব্য থেকে। সেই পুরোহিত মা’কে নিয়ে অনেক ভাল ভাল কথা বলছিলেন। তখনই তার মনে হয়, বাবাদের নিয়েও কিছু করা দরকার। পরে তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই পরের বছর ১৯১০ সালের ১৯ জুন থেকে বাবা দিবস উদ্যাপন শুরু করেন। কালক্রমে এসেছে বাংলাদেশেও। বর্তমানে এ দেশেও দিবসটি ভীষণ জনপ্রিয়।
×