ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার মানুষ ৬ দফাকে নিয়েছিল মুক্তি ও বাঁচার অধিকার হিসেবে

প্রকাশিত: ২২:৩০, ৮ জুন ২০২০

বাংলার মানুষ ৬ দফাকে নিয়েছিল মুক্তি ও বাঁচার অধিকার হিসেবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপনের পর এদেশের মানুষের জেগে ওঠা এবং দাবি আদায়ের পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, দেশের প্রতিটি অর্জনই আমাদের রক্তের বিনিময়ে পেতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবিটা জনগণ এমনভাবে লুফে নিয়েছিল, আমি জানি না পৃথিবীর কোন দেশে একটি দাবি এত দ্রুত এবং এত বেশি জনপ্রিয়তা পেতে পারে। কারণ বাংলার মানুষ ৬ দফাকে লুফে নিয়েছিল তাঁদের মুক্তি ও বাঁচার অধিকার হিসেবে। এটা প্রকৃতও তাই ছিল। বাংলার মানুষের কাছে মুক্তির দাবি হিসেবে এই ৬ দফা দাবি উদ্ভাসিত হলো। ৬ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ এই সংগ্রামের পথ বেয়েই আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ৬ দফা কেন দেয়া হয়েছিল? আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ দাবি উথাপন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে এই অনলাইন আলোচনাসভায় অংশ নিয়ে সভাপতিত্ব করেন। অনলাইন আলোচনাসভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর সঞ্চালনায় আলোচনাসভায় আরও বক্তব্য রাখেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ও শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মিত থিম সং ‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা, তুমি হৃদয়ের বাতিঘর’ পরিবেশন শেষে ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবসের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই ৬ দফা আন্দোলন করতে গিয়ে পাকিস্তানী শাসকদের হাতে নিহত শ্রমিক নেতা মনু মিয়া, আবুল হোসেন, শফিক সামছুলসহ যারা জীবন দিয়েছিলেন তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী ঐতিহাসিক ৬ দফার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ৬ দফা দাবিটা, বাংলার মানুষ এটা নিয়েছিল তাদের বাঁচার অধিকার হিসেবে। এটা মূলতই তাই ছিল। তার কারণ আমরা বাঙালীরা পাকিস্তান নামক দেশ হওয়ার পর আমরা দেখেছি বাঙালীদের অধিকার কেড়ে নেয়ার যে চেষ্টা। তিনি বলেন, ৬ দফার একটা পটভূমি আছে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হয়। আমরা পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত। পূর্বপাকিস্তান একটা প্রদেশ পাকিস্তানের, তাকে রক্ষার করার কোন ব্যবস্থাই পাকিস্তানী শাসকরা নেয়নি। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়, যেন মনে হলো ভারতের দয়ার ওপর আমরা পড়ে আছি। তিনি বলেন, এই যুদ্ধের পর একটি গোলটেবিল বৈঠক ডাকা হয় লাহরে। সর্বদলীয় বিরোধী দল এই গোলটেবিল বৈঠক ডাকে। সেই গোলটেবিল বৈঠকে জাতির পিতা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। সেখানে তিনি এই ৬ দফা দাবি উথাপন করেন। যে দাবির মূল বক্তব্য ছিল যে, প্রদেশ হিসেবে এই দেশের, আমাদের দেশের মানুষকে সুরক্ষিত করা। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা। এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নতি করা এবং প্রতিরক্ষার দিক থেকে এই অঞ্চলকে সুরক্ষিত করা। সেই সঙ্গে বাঙালীর যে অস্তিস্তের দাবি, সে দাবিটা তুলে ধরা। শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তান-ভারত তাসখন্দ চুক্তি করল সেখানেও আমাদের পূর্ববঙ্গ ছিল সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। তারপর ৬ দফা যখন দেয়া হলো তখন এদেশের মানুষ জেগে উঠল। এটাই ছিল সবচেয়ে বড় বিষয়। এদেশের মানুষ এত দ্রুত ৬ দফাকে শুধু সমর্থনই করেনি, তারা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে নিজের দাবি হিসেবে গ্রহণ করল। বাংলার মানুষের মুক্তির দাবি হিসেবে এই ৬ দফা দাবি উদ্ভাসিত হলো। এটা যে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল সে বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। এটা শুধু আমাদের না, প্রতিটি প্রদেশই এই সুবিধা পাবে। ৬ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন দমনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেন, পাকিস্তানি শাসকরা থেমে থাকেনি। যখনই প্রতিবাদ হয়েছে অগণিত নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করেছে, অত্যাচার করেছে। কারাগারের রোজনামচা বইটা পড়লে দেখবেন সেখানে কিভাবে অত্যাচার, নির্যাতন চলেছিল। দমন-নিপীড়নে ৬ দফা দাবি আরও জোরালো হওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে যখন বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে তখন আওয়ামী লীগে যিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। এভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চলেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ আরও বেশি সচেতন হচ্ছে, আরও বেশি সুসংগঠিত হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। অবশ্যই কিছু দালাল ছাড়া। সব সময় কিছু দালাল থাকে, এটাই সমস্যা। এই দাবি যখন সেই সভায় তুলে ধরতে যান তখনও অনেকেই বাধা দেয়। দুঃখজনক হলো আমাদের বাংলাদেশের একজন নেতা অন্য দলকে বাধা দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো এবং তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা দেয়া হলো। যেটা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিতি পেয়েছিল। আসলে মামলাটা ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে এবং সামরিক-বেসামরিক ৩৪ জনকে মামলার আসামি করা হয়। এই মামলা যখন শুরু হলো দেশের মানুষ আবার বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। এক পর্যায়ে আইয়ুব খান মামলা প্রত্যাহার করে সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে জনতার কাছে ফিরে এলেন। ৬ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৬ দফার ভিত্তিতে ’৭০ এর নির্বাচন। যে নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ৬ দফা এবং ৭ জুন এটা আমাদের, এই যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি এর জন্য এই দিবসটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা দেখেছি, ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়ে আমাদের রক্তের অক্ষরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে হয়েছে। আবার আমাদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন সেখানেও রক্ত দিয়ে লিখে যেতে হয়েছে-আমরা আমাদের স্বাধিকার চাই। এসময় তৎকালীন সময়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক ও প্রশাসনিক ও সামরিকভাবে বৈষম্য ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতি সব দিক থেকে এগিয়ে থেকেও আমরা (পূর্ব পাকিস্তান) সব সময় বঞ্চনার শিকার হতাম। বঙ্গবন্ধু সেই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর এই সংগ্রামের পথ বেয়েই আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। তাই ৭ জুন যারা জীবন দিয়ে বাঙালীর অধিকারের কথা বলে গেছে আমি তাদের স্মরণ করছি। স্মরণ করছি আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যিনি সময়োচিত পদক্ষেপ নিয়ে বাঙালীকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন। ৭ জুনের আন্দোলনের ভূমিকার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের কথাও স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি অর্জন রক্তের বিনিময়ে আমাদের পেতে হয়েছে। শহীদের রক্ত কখনও বৃথা যায় না। বৃথা যেতে পারে না। যায়নি। আজ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে/ আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা হয়েছিল। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারে আসে। এরপর আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম তাতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল। তিনি আরও বলেন, আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়শীল দেশে উন্নীত হয়েছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাস নামের একটি ভাইরাস এসে আজকে সকলের জীবনযাত্রা স্থবির করে দিয়েছে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা। আমি আশা করি- আমাদের দেশের প্রত্যেকটা মানুষ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়ম মেনে চলবেন। ইনশা আল্লাহ এখান থেকে আমরা মুক্তি পাব। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব। সিআরপিকে প্রধানমন্ত্রীর ১০ কোটি টাকা অনুদান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)-কে ১০ কোটি টাকা অনুদান প্রদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার সিআরপিকে ১০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন, যাতে এটি ভালভাবে পরিচালিত হতে পারে এবং জনগণকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য সেবা প্রদান করতে পারে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের চিকিৎসা, সহযোগিতা এবং পুনর্বাসনের জন্য দেশে ১৯৭৯ সালে সিআরপির যাত্রা শুরু হয়।
×