সমুদ্র হক ॥ আর কি ফিরে আসবে করোনা পূর্বের সেই দিনগুলো! করোনাকালে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব নিয়েই কি এগিয়ে যাবে আগামীর পৃথিবী। কেমনই বা হবে করোনা-পরবর্তী দিনগুলো! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাগুলোই বুঝি সঠিক হচ্ছে একবিংশ শতকে। দুই বিঘা জমি কবিতার উপেন চরিত্রের একটি পঙ্ক্তিতে লিখা আছে “ভাবিলাম হায় আর কি কোথায় ফিরে পাবো সে জীবন...”।
বৈশ্বিক মহামারী করোনার এই মহাদুর্যোগের সমাপ্তির এখনও কোন আশা জাগাতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। শুধু আশার বাণী ভ্যাকসিন বের হচ্ছে। মানুষ রোগমুক্ত হবে। নিরাশার বাণী কেউ বলছেন- এই ভাইরাসের ধরন ভিন্ন। কেউ বলছেন আরও ভয়ঙ্কর সময় সামনে। কেউ বলছেন ভাইরাস এ ও সি ইউরোপ ও আমেরিকায়। বি দক্ষিণ এশিয়ায়। বাদুর থেকে উৎপত্তি না রসায়নাগারে তৈরি এই নিয়ে আরেক বাকযুদ্ধ। একজন বলছেন এই ভাইরাস যাবে না। ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো প্রতিবছর একটি সময়ে আসবে। বিশ্বে ম্যালেরিয়া ইরাডিকেশনের সময় বলা হয়েছিল ‘কুইনাইন রোগ সারায় কুইনাইন সারাবে কে! করোনা সারাতে এই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনন (কুইনাইন) নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে।
বিশে^র মানুষ এখন করবে কি! বিপর্যস্ত অর্থনীতি ফিরিয়ে আনতে লকডাউনকে নতুন ফর্মুলায় ইমপ্লিমেন্ট করা হবে! মানুষ কি এক পর্যায়ে মরার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে বাঁচলে ফিরবে মরলে মরবে! ঘরবন্দী মানুষের এখন বহু ভাবনার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে এখনও এক মিটারের (প্রায় তিন ফুট) মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। কেউ বলছেন ব্যক্তি দূরত্ব। কেউ বলছেন করোনা দূরত্ব। ঘর থেকে বের না হয়ে কোথাও না গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ভার্চুয়াল (স্মার্টফোন ট্যাব ল্যাপটপে) লাইভ কথা বার্তা কী সমাজবদ্ধ মানবজীবন হলো!
আর কি ফিরে আসবে সৌহার্দের সাক্ষাতের উচ্ছ্বাসে একে অপরকে বুকে টেনে নেয়া। আপনজনের সাক্ষাতের আনন্দে এক সঙ্গে না বসে কি দূরত্ব বজায় রেখে বসে কথা বলতে হবে। মাস্ক পরে কেউ কারও মুখ দেখতে পারবে না। গ্লাভস হাতে সালাম বিনিময় করতে হবে। মা তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারবে না। প্রণয়ের মানুষকে দূরে থাকতে হবে। ছোঁয়া যাবে না। আলিঙ্গন করা যাবে না। বিশেষ কোন কারণে স্বজন ঘরে প্রবেশের পর তাদের শরীর ও হাত জীবাণুমুক্ত করতে স্প্রে করতে হবে। প্রস্থানের পর স্প্রে করতে হবে। বাড়ির লোকজনকে প্রয়োজেন গোসল সেরে কাপড় পাল্টাতে হবে। পরিধেয় কাপড় গরম পানিতে রাখতে হবে।
পারতপক্ষে আত্মীয়স্বজন আপনজন কেউ কারও বাড়িতে যাবে না। একসঙ্গে কোন যানবাহনে এক সঙ্গে বসা যাবে না। খাবার টেবিলে বসতে হবে দূরত্ব বজার রেখে। বন্ধু-বান্ধব ভালবাসার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পাশাপাশি বসে যাওয়া যাবে না। বাঙালীর সমাজ জীবনের সবচেয়ে মধুময় শব্দ কুটুম্বিতা কথাটি হারিয়ে যাবে করোনার গ্রাসে। স্বজন মারা গেলে অনেক দূরে থেকে তাকে দেখতে হবে- নিথর একটি মরদেহ পড়ে আছে। শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য কাছে যাওয়া যাবে না। দাফনের জন্য সরকারের নিযুক্ত কয়েকজন জীবাণুনাশক পোশাক পরে এসে প্লাস্টিকের প্যাকেটে লাশ ভরে চেইন আটকে গাড়িতে তুলে গোরস্থানে নিয়ে গিয়ে দ্রুত দাফন সারবে। মানুষের পৃথিবীর কী এই জীবন ধেয়ে আসছে!
অবরুদ্ধ, সঙ্গনিরোধ, ব্যক্তি পৃথকীকরণ কী আগামী পৃথিবীর জীবন। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে যাওয়া দুই মার্কিন নভোচারী এ্যান্ড্রু মার্গান, জেসিকা মায়ার ও একজন রুশ নভোচারী ওলেগ স্ক্রাইপোচকা পৃথিবীতে ফিরে এলেন গত ১৭ এপ্রিল। মহাকাশ যান থেকে নেমেই তারা স্তম্ভিত। মাত্রাতিরিক্ত নিরাপত্তার পোশাক পরা একটি টিম তাদের তিনজনকে আলাদা করে দিয়ে জীবাণুমুক্ত পোশাক পরিয়ে তিনটি যানে তিনটি স্থানে নিয়ে গেলেন। ভিডিও কলে সাংবাদিকদের জেসিকা মায়ার বললেন, ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে পৃথিবী গ্রহকে আগের মতোই সুন্দর দেখায়। তিনি ভাবতেই পারছেন না উর্ধকাশের ভুবন থেকে নেমে এসে মর্ত্তের সেই সুন্দর ভুবনকে (পৃথিবীতে) অচেনা দেখতে পাবেন। পৃথিবীতে ফিরে পরিবারও বন্ধুদের কাউকে আলিঙ্গন করতে পারবেন না। এটা ভাবতেও পারেননি। তিন নভোচারী বললেন “কি পৃথিবী রেখে গেলাম আর কোন পৃথিবীতে ফিরলাম!”।
মানুষের পৃথিবীর করোনাকালীন এই অভ্যস্ত জীবন কি বয়ে বেড়াতে হবে করোনা পরবর্তী মানব পৃথিবীর জীবনে! বিজ্ঞানীরা বলছেন সামাজিক দূরত্ব বহাল রাখতে হবে অন্তত ২০২২ অথবা ২০২৪ সাল পর্যন্ত। তাহলে তো কবিগুরুর সেই কবিতার (দুই বিঘা জমি) জমিদার ও উপেন চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয় “আর কি কোথাও ফিরে পাবো সে জীবন”। নভোচারীদের মতো বলতে হবে এ কোন পৃথিবী!