ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার মধ্যেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২১ এপ্রিল ২০২০

করোনার মধ্যেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রধানমন্ত্রীর আদেশের পরেও টনক নড়েনি কারও। করোনা নিয়ে ব্যস্ত সকল কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি। অথচ এডিস মশা নিধনে পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রাণঘাতী ডেঙ্গু ক্রমেই গত বছরের তুলনায় ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আবারও শতর্ক করে বলেছেন, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা গত বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় বেড়েছে প্রায় বহুগুণ। আবার হাসপাতালেও ঠিকভাবে চিকিৎসা পাচ্ছে না রোগীরা। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও আসছে না কোন তথ্য। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমও স্থবির। গত বছর তিন মাসে যেখানে রোগী ছিল ৪৮ জন, সেখানে এ বছর প্রথম তিন মাসে রোগী হয়েছে ২৭৫ জন। করোনার কারণে চলতি মাসে জটিলতা আরও বেড়েছে। এতদিন ডেঙ্গু হলে হাসপাতালে যেতে পারলেও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। হাসপাতালে হঠাৎই কমে গেছে ডেঙ্গু রোগী। ফলে সরকারের কাছে হিসেবও নেই। আক্রান্ত হলেও ভয়ে থাকছেন বাসায়। বিষয়টিকে আরও ভয়াবহ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মশা নিধনের কোন উদ্যোগ না থাকায় পরিবেশে এডিসের ঘনত্বও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। করোনার সঙ্গে এডিস মশা নিধনে ত্বরিত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ক্রমেই আরও খারাপ হবে বলে সতর্কও করেছেন তারা। গত ৩১ মার্চ এক অনুষ্ঠানে মশা কানের কাছে ‘সঙ্গীত চর্চা’ করছে বলে জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মশার প্রাদুর্ভাবটা আস্তে আস্তে শুরু হবে। তারপর আসবে ডেঙ্গু। এ বিষয়ে এখন থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে জনপ্রতিনিধি ও সরকারী কর্মকর্তাদের। প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন, আমাদের কিন্তু আরও সতর্ক থাকতে হবে, কালকে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন মাঝে মাঝেই দেখলাম মশারা সঙ্গীত চর্চা করছে। মশার গান শুনলাম। গুন গুন করে কানের কাছে বেশ গান গাচ্ছিল। অর্থাৎ মশার প্রাদুর্ভাবটা কিন্তু আস্তে আস্তে বাড়বে। তারপর আসবে ডেঙ্গু। তাই আমাদের এখন থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ করোনার সঙ্গে যদি আবার মশা যোগ হয়, ডেঙ্গু আসে, সেটা আমাদের জন্য আরও মারাত্মক হয়ে যাবে। সেটা যেন না আসতে পারে, সে জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা একান্তভাবে দরকার। নিজের বাড়িঘর শুধু না, যে যে এলাকায় বাস করছে, আশপাশে কোথাও যেন পানি বা জলাবদ্ধতা না থাকে, মশার প্রজনন যেন না থাকে, ডিম পাড়ার সুযোগ যেন না পায়, সে জন্য সবার দৃষ্টি দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। বিশেষজ্ঞরা করোনা মোকাবেলায় এডিস মশা নিধনের সকল কর্মসূচী সচল রাখার সুপারিশ করে বলেছেন, করোনা নামের একটি শত্রুর মোবাবেলা করতে গিয়ে যেন ঘরের আরেকটি দরজা আমরা খুলে না রাখি। তাহলে সেই দরজা দিয়ে দ্বিতীয় শত্রু প্রবেশ করবেই। দুটি দরজাতেই পাহারা বসাতে হবে। অন্যথায় বিপদ মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ইতোমধ্যেই মশা নিধনে কোন পদক্ষেপ না থাকায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ডোবা, খালে মশার উপদ্রব বেড়েছে। গত ক’দিনে মশার উপদ্রব বেড়েছে বাসা বাড়িতে। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এডিসের মাত্রা বাড়বে দ্রুতহারে, যা চিন্তার বিষয়। গত বছর দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল ডেঙ্গু। সরকারী হিসেবেই গত বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। মারা গেছেন ২৬৬ জন। যদিও বেসরকারী হিসেবে গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। গত বছর মশা নিধনের কার্যক্রমে সিটি কর্পোরেশনের গাফিলতির জন্য সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। বিশেষত ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র সাঈদ খোকনের ব্যর্থতার জন্য ভুগতে হয়েছে সরকারকে। গত বছর মার্চের শেষদিকে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। জেলায় জেলায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। সরকারী বেসরকারী হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও বেশি রোগী ভর্তি হয়; উপায়ান্তর না পেয়ে মেঝে, বারান্দায় বা হাসপাতালের ফাঁকা স্থানগুলোতেও ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য শয্যা পাতা হয়। সে সময় ডেঙ্গুর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব ছাড়াও ছিল আক্রান্তদের ওষুধের সঙ্কট। এমন অবস্থায় চলতি বছর এডিস মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপের পরামর্শ ছিল বিশেষজ্ঞদের। তবে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেই। এর মধ্যেই ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে করোনাভাইরাস। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দফতর এখন ব্যস্ত করোনা মোকাবেলা করা নিয়ে। এই সুযোগে অনেকটা নির্বিঘেœই রাজধানীর ডোবা, খালগুলোতে মশার উপদ্রব বাড়ছে। ক’দিন ধরে বাসাবাড়িতে ও মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। মাঝে বৃষ্টি হওয়ায় বাড়ছে উদ্বেগ। কিন্তু একটি হিসেবেই বলে দিচ্ছে পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় ইতোমধ্যেই ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। আবার মশা বাড়লেও এখন পর্যন্ত নেই মশা নিধনের কোন উদ্যোগ। এদিকে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিশ^ব্যাপী ছোবল মোকাবেলায় বাংলাদেশেও সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দফতরের মনোযোগ একটি জায়গাতেই। মশা নিধনে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেই সিটি কর্পোরেশনসহ কোন পক্ষেরই। ফলে নির্বিঘেœ ছড়াচ্ছে এডিসসহ অন্যান্য রোগ বহনকারী মশা, পাল্লা দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে তারা এখন পর্যন্ত বড় কোন পদক্ষেপ নিতে না পারলেও গত মাসের ৫ মার্চ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এডিস মশার ঘনত্ব নির্ণয়ে জরিপ পরিচালনা করেছে। কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে গত বছরের তুলনায় এবার পরিবেশে এডিসের ঘনত্ব অনেক বেশি। যা সুখকর নয়। দেশে ডেঙ্গু ও এডিস মশা নিয়ে কাজ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। সরকারের সঙ্গেও একই ইস্যুতে কাজ করা এ বিশেষজ্ঞও সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, গত বছরের জানুয়ারিতে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল ৩৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮ আর মার্চে ছিল ১৭ জন। অন্যদিকে এবার জানুয়ারিতে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন। মার্চে করোনার কারণে হাসপাতালে জটিলতায় আতঙ্কে ডেঙ্গু হলেও আসলে কারও খবর জানা যাচ্ছে না। মার্চ-এপ্রিলে তাই হিসেব মিলবে না। এপ্রিলে গত বছর ছিল ৫৮ জন, এবার এখন পর্যন্ত ১৯ জন। করোনার কারণে ভয়ে মানুষ হাসপাতালে যেতে পারছে না। ফলে গত অনেক দিন দেখা গেছে, কোন ডেঙ্গু রোগীই নেই! পরিবেশে এডিসের ঘনত্ব চিন্তার বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত বছর এই সময়ে মাসে ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব যা ছিল এবার একই সময়ে তা অনেক বেশি। ঘনত্ব বাড়লে ঝুঁকিও বাড়বে। এরকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাও আমরা পেয়েছি। তাছাড়া বৃষ্টিও হয়েছে। তাই এই সমস্যা আরও বাড়বে যদি পদক্ষেপ না নেয়া হয়। আশঙ্কা করছি এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এবার বর্ষার মৌসুমে জুন-জুলাই মাসে গতবারের চেয়ে ডেঙ্গু রোগী অনেক বেশি হবে। পরিস্থিাতি আরও খারাপ হবে। তাহলে করণীয় কি? অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মার্চ মাসেই সকলকে সতর্ক করেছেন। আমার জানা মতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা করছে। মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার পরামর্শ হচ্ছে ‘মার্চ, এপ্রিল এবং মে এই তিন মাস এডিস মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করার ওপর জোর দেয়া দরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন রাসায়নিকের মাধ্যমে এডিস মশা ধ্বংস করতে হবে। এজন্য সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে সক্রিয় হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি এখন ওই দিকেই। তবে একই সঙ্গে অবশ্যই ডেঙ্গু পরিস্থিতির দিকেও নজর দিতে হবে। এটাও জরুরী। কারণ ইতোমধ্যেই নজরের অভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের বছরের তুলনায় খারাপ হয়ে গেছে। তাই আমার সুপারিশ হলো, করোনা একটি শত্রু। ওই শত্রুকে মোবাবেলা করতে হবে একই সঙ্গে অন্য শত্রু যেন আক্রমণ করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। একটি শত্রুর মোবাবেলা করতে গিয়ে যেন ঘরের আরেকটি দরজা আমরা খুলে না রাখি। তাহলে সেই দরজা দিয়ে দ্বিতীয় শত্রু প্রবেশ করবেই। দুটি দরজাতেই পাহারা বসাতে হবে। অন্যথায় বিপদ মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে।
×