ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিতে চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ১২ এপ্রিল ২০২০

মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিতে চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে চীনা অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিতে বাধার মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে। কাক্সিক্ষত সময়ে কাজ না এগোলে বাড়তে পারে প্রকল্প ব্যয়ও। বাংলাদেশে কর্মরত অনেক চীনা সে দেশে আটকা পড়েছেন। আর সময়মতো কাজ না এগোলে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে বা বাড়ানোর অজুহাত তোলা হতে পারে। কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি প্রকল্পে কর্মরত চীনের শতাধিক কর্মকর্তা তাদের ছুটি আরও বাড়িয়েছেন। শুধু পদ্মা সেতুতেই চীনের ১১০০ নাগরিক কাজ করছেন। তাদের মধ্যে ছুটিতে দেশে গিয়েছিলেন ২৫০ জন। এ ছাড়া পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুত কেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের নাগরিকরা বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত আছেন। এসব প্রকল্পে দেড় হাজার চীনা নাগরিক কাজ করছেন। তার বাইরে আরও কিছু প্রকল্পে ৫০০ চীনা নাগরিক সহায়তা করছেন। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত ৩৫ চীনা নাগরিককে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত চীনের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন। তাদের ফেরা অনিশ্চিত। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, ঋণ, অনুদান, বিনিয়োগ এবং বড় প্রকল্পগুলোয় ক্রমেই সম্পৃক্ত হচ্ছে চীন। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে সম্পৃক্ততা বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৪শ’ চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে। বাংলাদেশের ১২টি প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে চীন। এসব প্রকল্পে দেশটির মোট সহায়তার পরিমাণ ১ হাজার ১১৫ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রোড ট্রান্সপোর্ট এ্যান্ড হাইওয়ের ১৬০ কোটি, রাজশাহী ওয়াসায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে ৫০ কোটি ডলার, বিদ্যুত খাতের ডিপিসিতে পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্কে ৫০ কোটি, পদ্মা সেতু রেল সংযোগের দুই প্রকল্পে ২৫৮ কোটি ডলার, পাওয়ার গ্রিডে ১৩২ কোটি ডলার এবং টেলিকমিউনিকেশন আধুনিকায়নে ২০ কোটি ডলার সহায়তা করছে চীন। এ ছাড়াও আরও ৯টি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। এসব প্রকল্পে সহায়তার পরিমাণ ৮০৮ কোটি ডলার। করোনায় বিপন্ন মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে কয়েকটি খাতের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, তার মধ্যে রেমিট্যান্স অন্যতম। তৈরি পোশাকশিল্প থেকে রফতানি আয় যেখানে কমতির দিকে, সেখানে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স লেনদেনের ভারসাম্য রাখছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক রফতানি কমে এসেছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে খ্যাত মধ্যপ্রাচ্য বিশেষত মালয়েশিয়া, কাতার ও সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানোয় নানা বিড়ম্বনা যুক্ত হয়েছে নিকট অতীতে। নারী গৃহকর্মীদের নিপীড়ন আকামা নবায়ন না করা, নতুন শ্রমিক গ্রহণ না করা প্রভৃতি সমস্যার মধ্যে এবার যোগ হয়েছে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ভাইরাসের আঘাত মোকাবেলায় বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সন্দেহ নেই, এর প্রভাব বাংলাদেশের শ্রমবাজারে পড়বে। দেখার বিষয় এ নিষেধাজ্ঞা কতদিন বহাল থাকে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে যেসব শ্রমিক বেড়াতে এসেছিলেন, তারা ফেরত যেতে পারছেন না। ধারণা করা হচ্ছে এসবের প্রভাব রেমিট্যান্সপ্রবাহের ওপর পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় উৎপাদন কার্যক্রমও বিঘিœত হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে সেবা খাত করোনার প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়ছে। এসব খাতেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী কাজ করেন। সঙ্কট দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের শ্রমিকদের আয় হারানোর শঙ্কা রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে অবস্থানরত প্রবাসী শ্রমিকদের দেখভালের দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধিসহ ছুটিতে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের শঙ্কামুক্ত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় বাংলাদেশী যাতে কাজ না হারান, তার নিশ্চয়তা বিধানকল্পে এখনই আলোচনা শুরু করা আবশ্যক। চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া ভাইরাসটি এরই মধ্যে অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে বড় অঙ্কের রেমিট্যান্স আসে এমন দেশও রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইতালি কানাডা, জাপান, হংকং, আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এ ভাইরাস। সিঙ্গাপুরে অবস্থান করা বাংলাদেশীদের এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব দেশ থেকে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। ফলে সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহে নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের ২ শতাংশ প্রণোদনা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তা-ই এখন দেখার বিষয়। আগামী দিনগুলোয় দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে আসবে। একইসঙ্গে ব্যবসায়িক মন্দার কারণেও রেমিট্যান্সপ্রবাহও কমে আসবে। দেশের মোট রেমিট্যান্সের মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর-এ চার দেশ থেকে আসে ১১ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে আসে সোয়া ১২ শতাংশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসে প্রায় ৬০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে সাড়ে ১১ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসে সাড়ে ৭ শতাংশ। আলোচ্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিকের দেশগুলোয় করোনার প্রভাব ভয়ানক রূপ নিয়েছে। ইউরোপীয় অঞ্চলের কিছু দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশও করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে সৌদি আরব থেকে। এ দেশটিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমট্যান্স আসে। এখানেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে এসব দেশে কর্মরত অনেক প্রবাসীই যেমন বাংলাদেশে চলে আসছেন, তেমনি দেশ থেকে নতুন করে ওইসব দেশে কোনো কর্মী যাচ্ছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে রেমিট্যান্সপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একইসঙ্গে করোনাভাইরাসের সঙ্কট দীর্ঘমেয়াদী হলে এ খাতে নেতিবাচক অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিশ্বে বর্তমানে এক ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এর নেতিবাচক প্রভাব কমবেশি অনেক দেশেই পড়েছে। এ মন্দার একটা প্রভাব প্রবাসী আয়ে পড়তে পারে। কেননা যেসব দেশে এ মন্দা জেঁকে বসছে, সেসব দেশের বাণিজ্যিক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে কাজের ক্ষেত্র কমে যাবে। এতে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যেতে পারে। এছাড়া জনশক্তি রফতানি এবং বিদেশে যারা অবস্থান করছেন, তাদের ওপর করোনাভাইরাসের সাময়িক প্রভাব তো আছেই। কেননা করোনাভাইরাস যেভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, এতে অর্থনৈতিক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হবে। তাই আগে থেকেই প্রাবসীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি দেশে আটকে পড়াদের করোনার প্রভাব কেটে যাওয়ার পর দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে প্রবাসী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুরক্ষা নিশ্চিত এবং জনশক্তি রফতানি ও রেমিট্যান্সপ্রবাহের গতি ধরে রাখতে দূতাবাসগুলো যেন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তার পরিকল্পনা নিতে হবে। তবে, আশার কথা এই যে, বাংলাদেশ অন্তত একদিক থেকে এগিয়ে আছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায়। দেশে কোন খাদ্য সঙ্কটের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তবে এর প্রভাব জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক হবে না বলেই প্রতীয়মান হয় কেননা, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভাল। প্রণোদনা দেয়ায় প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণও বেড়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা কয়লা বিদ্যুত, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রসহ দশটি মেগা প্রকল্প বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। ফলে গড় জাতীয় প্রবৃদ্ধি আট শতাংশের ওপরে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে।
×