ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধা, ভালবাসায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ কৃতজ্ঞ জাতির

প্রকাশিত: ১১:০০, ১৮ মার্চ ২০২০

শ্রদ্ধা, ভালবাসায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ কৃতজ্ঞ জাতির

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ পর্দা উঠল মুজিববর্ষের। জাতির পিতার শততম জন্মদিনটি এবার রূপ নিয়েছিল এক ভিন্ন মাত্রায়। দিনভর অবনত মস্তক আর হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণের মধ্য দিয়ে শুরু হলো জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বছরব্যাপী ‘মুজিববর্ষে’র উৎসব। জন্মশতবার্ষিকীতে কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করলেন বাংলাদেশ নামক ভূখ-ের স্বাপ্নিক স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানকে। মুজিববর্ষ মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত চলবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে শুধু দেশেই নয়, ইউনেস্কোর উদ্যোগে সমগ্রবিশ্বেও উদ্যাপিত হচ্ছে মুজিববর্ষ। দেশবাসীর মতো বিশ্ববাসীও বছরব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি রাষ্ট্রের রূপকার ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাবেন। বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে দেখা দেয়া করোনাভাইরাসজনিত কারণে মুজিববর্ষের কর্মসূচীতে অনেক কাটছাঁট করা হলেও কৃতজ্ঞ বাঙালীর জাতির ইতিহাসের মহানায়কের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি। বরং প্রতিবারের মতো এবারও সব শ্রেণী-পেশার মানুষ ভাইরাসের ভয় জয় করেই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন জাতির পিতার প্রতি। তবে এবারের বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিনের বিশেষ বিশেষত্ব ছিল যে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মের সময় দিনটি ছিল মঙ্গলবার। শততম জন্মবার্ষিকী পূর্তির দিনটিও ছিল মঙ্গলবার। দিনভর ধানম-ির ৩২ নম্বর, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়াও জাতির পিতার জন্মক্ষণ রাত ৮টায় বর্ণাঢ্য আতশবাজি, ফানুস উড়ানোসহ জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হয় মুজিববর্ষের বছরব্যাপী অনুষ্ঠান। দেশের মানুষ ঘরে বসেই সরকারী-বেসরকারী টেলিভিশনের মাধ্যমে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানমালা প্রত্যক্ষ করেন। জাতির পিতার জন্মদিনটি সারাদেশে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবেও উদ্যাপিত হয়। তবে প্রতিবারের মতো শিশু সমাবেশসহ শিশু-কিশোরদের সব ধরনের জমায়েতের কর্মসূচী এবার বাতিল করা হয়। দেশবিরোধী সব ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে সন্ত্রাস-নাশকতা-জঙ্গীবাদ ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের দৃপ্ত শপথে মঙ্গলবার বাঙালী জাতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। কৃতজ্ঞ জাতি সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে পরাজিত করে দেশের চলমান উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা অব্যাহত এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথও নিয়েছেন। জাতির পিতার প্রতিকৃতি ও মাজারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন, কেক কাটা, স্বেচ্ছায় রক্তদান, বিনামূল্যে চিকিৎসা, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনসহ সরকারী-বেসরকারী নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে পালিত হয় বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস। করোনাভাইরাসের ভয় কৃতজ্ঞ জাতিকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে মঙ্গলবার ভোর থেকে ঐতিহাসিক ধানম-ির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাসভবন এবং টুঙ্গিপাড়ায় মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে জমায়েত হয় সর্বস্তরের মানুষ। তবে বিশ্ব পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সব ধরনের গণজমায়েতের কর্মসূচী বাতিল করে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তাই এবার বৃহৎ কোন গণজমায়েত না হলেও শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের কমতি ছিল না। ক্ষণগণনার ঘড়ির কাঁটা শূন্য ঘরে পৌঁছা মাত্র সোমবার রাত ১২টা ১ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবনসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আতশবাজি, লেজার শো, তোপধ্বনিসহ নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুজিববর্ষের সূচনা হয়। দিবসটি উপলক্ষে মঙ্গলবার শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের পাশাপাশি রাজধানীসহ সারাদেশে সীমিত পরিসরে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শের ওপর আলোচনা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বঙ্গবন্ধুর ওপর তৈরি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন এবং মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। মুজিববর্ষ উপলক্ষে মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডাসহ বিভিন্ন উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা সভা। দেশ ও জাতির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার সকালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে এই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রথমে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার সমাধিসৌধের বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। দুপুরে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দসহ অন্যরা বঙ্গবন্ধু মাজার কমপ্লেক্স মসজিদে আয়োজিত দোয়া-মাহফিলে অংশ নেন। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে বসেই দোয়া-মাহফিলে অংশ নেন। পরে দুপুর সোয়া ২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী ঢাকার উদ্দেশ্যে টুঙ্গিপাড়া ত্যাগ করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে টুঙ্গিপাড়ায় এসে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে ছোট বোন শেখ রেহানা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে প্রবেশ করেন জাতির পিতার মাজারে। এ সময় কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁকে স্বাগত জানান। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ এসে বঙ্গবন্ধু মাজারে প্রবেশ করলে তাঁকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী। এ সময় মাজারে উপস্থিত অন্যান্য সবাই হাত নেড়ে, স্লোগান দিয়ে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতিকে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন ও হলগুলোতে আলোকসজ্জায় সাজানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে কোরআন খতম ও বাদ-আসর মিলাদ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতন সংঘের উদ্যোগে মন্দিরে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিকেল ৪টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। সেখান থেকে ফিরে কেক কেটে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উদ্্যাপন করা হয়। এছাড়াও সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেলুন ও ফানুস উড়িয়ে দিবসের কর্মসূচী শেষ করেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি জাতির জনকের সমাধি প্রাঙ্গণে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে স্বাগত জানান। শেখ রেহানা, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং শেখ হেলাল উদ্দিন এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পরে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দলের পক্ষ থেকে জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। মুজিববর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের ওপর দিয়ে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো লাল-সবুজ আবির ছড়িয়ে মনোজ্ঞ প্রদর্শনী করেছে। হেলিকপ্টারগুলোতে জাতীয় পতাকা এবং মুজিববর্ষের লোগো খচিত ছিল। পরে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সমাধি প্রাঙ্গণে মিলাদ এবং দোয়া মাহফিলেও অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য জাতির পিতার সমাধিসৌধ প্রাঙ্গণ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ৩২ নম্বরে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ॥ এদিকে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। রাজধানীর ধানম-ি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার প্রতিকৃতির বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর স্বাধীনতার এই মহান স্থপতির প্রতি সম্মান জানানোর অংশ হিসেবে সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। জাতির পিতার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা এবং বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনকালে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও উপদেষ্টা পরিষদের নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতার প্রতিকৃতির বেদিতে আরেকটি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। এরপর জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পৃথকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অন্যান্য কর্মসূচি ॥ রাত আটটায় জাতির পিতার জন্মক্ষণে আতশবাজি পোড়ানোর মাধ্যমে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে জন্মশতবর্ষের উদযাপন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ঢাকাসহ সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর রূহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, দুস্থদের মধ্যে খাবার ও মিষ্টি বিতরণ, আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস উড়ানোসহ দিনভর নানা কর্মসূচী পালন করা হয়।
×