ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

আতশবাজিতে বর্ণিল রাতের আকাশ

‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা’ শত কণ্ঠে থিম সং

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ১৮ মার্চ ২০২০

‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা’ শত কণ্ঠে থিম সং

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যেদিকে ফেরাই ঘুরে যায় মুজিবের দিকে/বাংলার মানচিত্রে চেয়ে দেখো মুজিব চৌদিকে/উত্তরের মুজিব ডাকে, দক্ষিণেও ডাকে মুজিবর/মুজিবের কণ্ঠস্বরে গেয়ে ওঠে বাংলার অক্ষর ...। মঙ্গলবার এভাবেই মহামানবের মহিমা ছড়িয়েছে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে। দিনটি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবর্ষ। জন্মশতবর্ষে অবিসংবাদিত নেতার অবিনাশী কীর্তির কথা স্মরণ করেছে জাতি। নানা আয়োজন-আনুষ্ঠানিকতায় স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে জানানো হয়েছে ভালবাসার স্পর্শময় শ্রদ্ধাঞ্জলি। নিবেদিত হয়েছে বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতা এনে দেয়া মহামানবের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আর এদিন থেকেই শুরু হয় মুজিববর্ষের বছরব্যাপী অনুষ্ঠান। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাবে জনসমাগম এড়াতে রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজিত মুজিববর্ষের মূল অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছে দেশের সব টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মুক্তির মহানায়ক শিরোনামের দুই ঘণ্টাব্যাপ্তির অনুষ্ঠানটি শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণ রাত আটটায়। রাত দশটা পর্যন্ত চলমান অনুষ্ঠানটি একযোগে উপভোগ করেছেন সারাদেশের মানুষ। মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা সাজানো অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত হয়েছে জাতির জনকের জীবনের আদর্শ, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের অধ্যায়। সেই সুবাদে অনুষ্ঠান উপভোগের পাশাপাশি মহান নেতার অবিনাশী কীর্তির কথা গভীরভাবে রেখাপাত করেছে গোটা জাতির মননে। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। রাত আটটায় বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ থেকে আতশবাজির আশ্রয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এরপর মুজিববর্ষের উদ্বোধনী আয়োজনে দর্শকরা দেখেছেন জাতীয় প্যারেড স্কয়ার থেকে ধারণকৃত বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। দুই ঘণ্টাব্যাপ্তির অনুষ্ঠানে অনেকগুলো কঁচিকণ্ঠ মিলে গেছে এক সুরে। সম্মেলক সুরে শত শিশুর কণ্ঠে গীত হয়েছে সোনার বাংলার উচ্চারণমাখা জাতীয় সঙ্গীত। এরপর প্রচারিত হয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ভাষণ। জাতির উদ্দেশে উদ্দীপনাময় ভাষণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুভূতি প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধুর আরেক মেয়ে শেখ রেহানা। প্রচারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা ও সংস্থার প্রধানদের বাণী। যাদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, নেপালের বর্তমান রাষ্ট্রপতি বিদ্যা ভল্ডারী, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, ওআইসির মহাসচিব ইউসেফ আল-ওথাইমিন প্রমুখ। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর শত কণ্ঠে গাওয়া হয় মুজিববর্ষের থিম সং ‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা/তুমি হৃদয়ের বাতিঘর’। এই গানে দেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা। এছাড়া অনুষ্ঠানে পিতাকে নিয়ে শেখ রেহানার লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন শেখ হাসিনা। শত যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীর সুরের মূর্ছনায় উপস্থাপিত হয়েছে জাতির জনকের জীবনের নানা অধ্যায়। শতাব্দীর মহানায়ক শীর্ষক মনোমুগ্ধকর থিয়েট্রিকাল কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ, সাহস ও সংগ্রামের বিবরণসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা। জাতীয় সংসদ ভবন থেকে পিক্সেল ম্যাপিং বা লেজার শোর মাধ্যমে শেষ হয় অনুষ্ঠান। আতশবাজির মতো লেজার শোটিও সরাসরি সম্প্রচারিত হয় টিভি পর্দায়। সহ¯্রাধিক শিল্পীর সম্মিলনে শতাব্দীর মহানায়ক শীর্ষক কোরিওগ্রাফিতে নৃত্যাশ্রিত দৃশ্যকাব্যের সঙ্গে সুরারোপিত চিত্রপটে উদ্ভাসিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। গানের সঙ্গে কবিতার মিতালীতে নাচের মুদ্রায় এগিয়ে যায় পরিবেশনা। নাচের সমান্তরালে বেজে উঠেছে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের সুর। সেই সুরধারা থেকেই উঠে আসে শৈশব-কৈশোর থেকে শেখ মুজিবের সংগ্রামী জীবনের নানা অধ্যায়। সেই জীবনে ছিল খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্প। নেতা থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার চিত্রভাষ্য। কেমন করে স্বাধীনতার মহান স্থপতি হয়ে উঠলেন কর্মী থেকে রাজনীতির কবি; উপস্থাপিত হয় সেই দৃৃশ্যচিত্র। মুজিবের জননেতা থেকে বিশ্বনেতায় পরিণত হওয়ার আখ্যানটিও উপস্থাপিত হয় সম্মিলিত শৈল্পিক পথরেখায়। নৃত্য-গীত ও কবিতার সম্মিলনে সৃষ্ট ৪৫ মিনিটের কোরিওগ্রাফিটি দর্শকের নয়নে ছড়িয়েছে মুগ্ধতা। কোরিওগ্রাফির পাশাপাশি উদ্বোধনী আয়োজনের সাংস্কৃতিক পরিবেশনার অন্যতম আকর্ষণ ছিল শত শিল্পীর যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনা এবং বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ কোরিগ্রাফার আকরাম খানের নৃত্য পরিবেশনা। একইভাবে দেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীদের গাওয়া ‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা/তুমি হৃদয়ের বাতিঘর’ শিরোনামের থিম-সংটি হৃদয় রাঙিয়েছে শ্রোতা-দর্শকের। শতাব্দীর মহানায়ক শীর্ষক প্রযোজনাটির গবেষণা, গ্রন্থনা ও নিদের্শনা দিয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। শেখ মুজিবের আত্মত্যাগ, সাহস ও সংগ্রামী জীবনকে ছয়টি পর্বের মাধ্যমে মেলে ধরা হয় কোরিওগ্রাফিতে। সেই পর্বগুলো ছিল জন্মজয়ন্তী, নতুন যৌবনের দূত, ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি, তেইশ বছরের ইতিহাস, ৩০৫৩ দিনের কারাবাস ও স্বাধীন দিকে দিকে। এসব পর্বের মাধ্যমে উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশোর থেকে তারুণ্য, গ্রাম বাংলার মানুষের প্রতি তার ভালবাসা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন কিংবা ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা থেকে অবিচল নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা। সেই সঙ্গে স্বাধীন দেশে স্বপ্নের সোনার বাংলার গড়ার পরিক্রমায় সাড়ে তিন বছরের শাসনকালও উঠে আসে কোরিওগ্রাফিতে। দেশের খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পীদের মেধার সম্মিলন ছিল এই কোরিওগ্রাফি। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেন নৃত্যশিল্পী ওয়ার্দা রিহাবের নেতৃত্বাধীন ধৃতি নর্তনালয়। নাচের নেপথ্যে বেজেছে ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘শিকল পরার ছল’সহ কয়েকটি গান ও কবিতার কিছু অংশ। জন্মজয়ন্তী পর্বের কোরিওগ্রাফিতে নাচের সমান্তরালে বেজেছে ‘ওই মহামানব আসে’ গানের সুর। বঙ্গবন্ধুর তারুণ্য মেলে ধরা যৌবনের দূত পর্বে নাচের ‘আমরা যৌবনের দূত’ শীর্ষক সঙ্গীত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অধ্যায়কে উপজীব্য করে গড়া ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি পর্বে নাচের সহযোগে ছিল ‘ভয় কি মরণে’ গানের সুর। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর প্রেক্ষাপটে গড়া তেইশ বছরের ইতিহাস পর্বে নাচের সঙ্গে বেজেছে ‘কারার ঐ লৌহক পাট’ গানের সুর। বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা ‘৩০৫৩ দিনের কারাবাস’ পর্বের কোরিওগ্রাফিতে নান্দনিক নৃত্যের সঙ্গে বেজেছে ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল’ গানের সুর। ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ সুরটি ভেসেছে স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর সাড়ে ৩ বছরের শাসনামলের চিত্র তুলে ধরা হয় ‘স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে’ পর্বের নাচে। সহ¯্রাধিক নৃত্যশিল্পীর সম্মিলনে সৃষ্ট কোরিওগ্রাফিটি ফুটিয়ে তোলে কয়েকটি নৃত্যদল। দলগুলোর নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন মুনমুন আহমেদ, তামান্না রহমান, র‌্যাচেল প্রিয়াংকা প্যারিস, অর্নব অমিত, তুষার ইভানসহ একঝাঁক নৃতশিল্পী। আছে গোবিন্দগঞ্জের বাবু লালের নৃত্যদলও। মুজিববর্ষের উদ্বোধনী আয়োজনে শত কণ্ঠে গীত হয়েছে ‘বাংলার ধ্রুবতারা তুমি’ শিরোনামের থিমসং। খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পীদের অনবদ্য গায়কীতে শ্রুতিমধুর পরিবেশনাটিতে কণ্ঠ মেলান সাবিনা ইয়াসমিন, সৈয়দ আব্দুল হাদী, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফরিদা পারভীন, রফিকুল আলম, খায়রুল আনাম শাকিল, ফকির আলমগীর, সামিনা চৌধুরী, বাপ্পা মজুমদার, কণাসহ নবীন-প্রবীণ শিল্পীদল। আর তাদের সঙ্গে সমানতালে কণ্ঠ ছেড়ে গেয়েছেন শেখ রেহানা। কবি কামাল চৌধুরীর লেখা গানটিতে সুরারোপ করেছেন নকীব খান। এছাড়াও অনুষ্ঠানে সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত ‘আমার গর্ব মাংলার মাটি/সেরা সন্তান তুমি/তুমি দিয়েছো ঠিকানা আমার জননী জন্মভূমি’ শীর্ষক সঙ্গীত। এছাড়াও শত শিশু শিল্পীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘ধন্য মুজিব ধন্য’ শীর্ষক সঙ্গীত। অনুষ্ঠানের আরেক আকর্ষণ ছিল যন্ত্রসঙ্গীতের সুরেলা শব্দধ্বনি। পরিবেশনাটি উপস্থাপন করেন দেশের খ্যাতিমান একশত যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী। বেজেছে বেহালা, সেতার, সরোদ, সারেঙ্গি, এ¯্রাজ, ম্যান্ডোলিনের সুর থেকে ঢোল-তবলার বোল। নেপথ্যে ভেসে বেড়ায় ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি’ গানের সুর। নয় মিনিটের এই যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনাটির পরিচালনায় ছিলেন ফুয়াদ নাসের বাবু। যন্ত্রসঙ্গীতের সুর মূর্ছনায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ; সেই সূত্র ধরে বর্ণিত হয় ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ, পঁচিশে মার্চের কালরাত থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। উদ্বোধনী আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে দর্শকরা দেখেছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের নির্দেশিত নয়নজুড়ানো নৃত্য পরিবেশনা। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণকে ভিত্তি করে সাজানো পরিবেশনাটির শিরোনাম ‘ফাদার : ভিশন অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’। গতির সঙ্গে শক্তির মিশেলে উপস্থাপিত হয় পরিবেশনাটি। আট মিনিটের দৃষ্টিনন্দন এই নৃত্য পরিকল্পনাটির সঙ্গীতায়োজনে ছিলেন ভিনসেনজো লামাগনা। রাত দশটায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় পিক্সেল ম্যাপিং প্রদর্শনের মাধ্যমে শেষ হয় মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
×