ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

কুড়িগ্রামের বিতর্কিত ডিসি প্রত্যাহার হচ্ছে, রিগানের জামিন

প্রকাশিত: ১০:৪৯, ১৬ মার্চ ২০২০

 কুড়িগ্রামের বিতর্কিত ডিসি প্রত্যাহার হচ্ছে, রিগানের জামিন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ মধ্য রাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে জেল-জরিমানা ও নির্যাতনের ঘটনায় তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ওই ঘটনার তদন্ত করে ডিসির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন রবিবার নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বলেন, তাকে (কুড়িগ্রামের ডিসি) প্রত্যাহার করা হবে। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। কর্ম অনুযায়ী শাস্তি হবে। তাকে প্রত্যাহারসহ বিধিমোতাবেক সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হতে পারে। পাশাপাশি কুড়িগ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে সাজা দেয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট এ সংক্রান্ত রিট শুনানিতে বলেছে, একজন সাংবাদিককে ধরতে মধ্য রাতে তার বাসায় ৪০ জনের বিশাল বাহিনী গেল, এ তো বিশাল ব্যাপার। তিনি কি দেশের সেরা সন্ত্রাসী? এ বিষয়ে দায়ের করা রিটের আংশিক শুনানিতে বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি সরদার মোঃ রশিদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রবিবার এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। আজ সোমবার এ বিষয়ে আদেশ দেয়া হবে। এদিকে কুড়িগ্রাম থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, সাংবাদিক আরিফুল এক লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা করেন। আরিফুল বলেন, ‘আমি আকুতি-মিনতি করি। আল্লাহর কসম দেই। সন্তানের কসম দেই। প্রাণ ভিক্ষা চাই তাদের কাছে। এরপরও তারা ক্ষান্ত হচ্ছিলেন না। তারা আমাকে বারবার কলেমা পড়তে বলছিলেন। এ সময় আরডিসি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।’ অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে এনকাউন্টার করা হবে বলে জানানো হলে এমন আকুতির কথা জানিয়েছিলেন সাংবাদিক আরিফুল। পরে তাকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতনসহ তার ভিডিও ধারণ করা হয়। জামিন পাওয়ার পর পরেই আরিফুলকে গুরুতর আহত অবস্থায় কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এ সময় উপরোক্ত কথাগুলো সাংবাদিকদের বলে কেঁদে ফেলেন আরিফুল ইসলাম। তখন এক আবেগ ঘন পরিবেশ তৈরি হয়। তাকে জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়। তার এই জামিন নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন স্বজনরা। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন রবিবার নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বলেন, তাকে (কুড়িগ্রামের ডিসি) প্রত্যাহার করা হবে। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। কর্ম অনুযায়ী তার শাস্তি হবে। তাকে প্রত্যাহারসহ সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হতে পারে। খসড়া তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তদন্তে অনেক অনিয়ম দেখেছি। বিভাগীয় প্রক্রিয়া অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। অহেতুক যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে; সত্যতা পেয়েছি বিধায় বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব ও উর্ধতন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী। ডিসি প্রত্যাহারের আদেশ জারির বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী নেই; মন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সংশ্লিষ্ট ফাইল অনুমোদন করলে ডিসিকে প্রত্যাহারের আদেশ জারি করা হবে। বিসিএস ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা সুলতানা ২০১৮ সালের ৩ মার্চ থেকে কুড়িগ্রাম জেলার ডিসির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কুড়িগ্রাম শহরের একটি সরকারী পুকুর সংস্কারের পর তিনি নিজের নামানুসারে ওই পুকুরের নাম ‘সুলতানা সরোবর’ রাখতে চেয়েছিলেন বলে বাংলা ট্রিবিউনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রায় এক বছর আগে। এরপর বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে গত ১৩ মার্চ রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে মাদক রাখার অভিযোগে এক বছরের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা ওই অভিযান পরিচালনা করেন। এ ঘটনায় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ডিসির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অনেকেই ডিসি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন। ওই ঘটনা তদন্ত করতে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে নির্দেশ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। রংপুর বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার (রাজস্ব) মাসুদ রানা বিষয়টি তদন্ত করেন। তিনি রবিবার দুপুরেই তদন্ত প্রতিবেদন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠান বলে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা খসড়া একটা প্রতিবেদন পেয়েছি। মূল প্রতিবেদন কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছবে। আমরা তদন্ত করেছি, তদন্ত প্রতিবেদনে আমরা অনেক অনিয়ম দেখেছি। সেই অনিয়ম অনুযায়ী এরইমধ্যে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। তার বিরুদ্ধে আমাদের ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিউর অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তাৎক্ষণিক কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নজরে রয়েছে বিষয়টি। অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আরিফুল ইসলাম জামিন পেয়েছেন এবং তিনি মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু সরকারের যে ভাবমূর্তি নষ্ট হলো সে বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। অল্প সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে। আমাদের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যে নিয়ম-কানুন আছে সে অনুযায়ী কাজগুলো হয়নি এবং যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলোর সত্যতা পেয়েছি। বিধায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি। ডিসি ছাড়া জেলা প্রশাসনের যেসব ম্যাজিস্ট্রেট ওই ঘটনায় সম্পৃক্ত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রত্যেকে কী রোল প্লে করেছেন, সে রোলটি যদি আইন বহির্ভূত হয়, তাহলে অবশ্যই দোষী সাব্যস্ত হবে এবং বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডিসির অধীনস্তরা কাজে কোন গাফিলতি করেছেন কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ডিসির বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে- জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রথমত তাকে প্রত্যাহার করা হবে। দ্বিতীয়ত, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে এবং সে অনুযায়ী বিচার হবে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী ১৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এসেছিলেন, তিনি সেভাবে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স এবং জনমুখী জনপ্রশাসন গড়ার ক্ষেত্রে যে কোন অন্তরায় থাকলে সেটা দূর করা এবং সে ক্ষেত্রে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। এখানে কাউকে ছাড় দেয়ার কোন ব্যাপার নেই। দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ সাজা হবে। কুড়িগ্রামের ডিসির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ উঠেছিল- এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, পাঁচ-ছয় হাজার কর্মকর্তা। এর মধ্যে দুই একজন খারাপ হতে পারে। যখন আমরা নিয়োগ দেই তখন তো দু’একটি ভুল হতেই পারে। একজন কর্মকর্তার অতীত কর্মকা- বিচার-বিশ্লেষণ করে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, তখন এসব বিষয় আসেনি। দু’একজন কর্মকর্তার অনিয়মের দায়ভার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কখনই গ্রহণ করে না। ডিসি নিয়োগের জন্য আগে শুধু কিছু সংস্থা থেকে প্রতিবেদন নেয়া হতো; এখন জেলা প্রশাসক, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়াও স্বাধীনতার পক্ষের লোকের কাছেও আমরা খোঁজখবর নেই। এদিকে কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সুজাউদ্দৌলা সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানের জামিন মঞ্জুর করেছেন। একই সঙ্গে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাদ- দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও হয়েছে। হাইকোর্টের বিস্ময়! কুড়িগ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে সাজা দেয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট এ সংক্রান্ত রিট শুনানিতে বলেছে, একজন সাংবাদিককে ধরতে মধ্য রাতে তার বাসায় ৪০ জনের বিশাল বাহিনী গেল, এ তো বিশাল ব্যাপার। তিনি কি দেশের সেরা সন্ত্রাসী? এ বিষয়ে দায়ের করা রিটের আংশিক শুনানিতে বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি সরদার মোঃ রশিদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রবিবার এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। আজ সোমবার এ বিষয়ে আদেশ দেয়া হবে। শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ও আইনজীবী ইশরাত হাসান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল দেবাশীষ ভট্টাচার্য। একই সঙ্গে মধ্য রাতে অভিযান পরিচালনার কারণসহ রাষ্ট্রপক্ষের কাছে পাঁচটি বিষয়ে তথ্য জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। আজ সোমবারের মধ্যে এ বিষয়গুলো রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে জানাতে হবে। রিট আবেদনের আংশিক শুনানিতে হাইকোর্ট জানতে চান, আদালত টাস্কফোর্স ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় কে ছিলেন, তা জানাতে বলেছে রাষ্ট্রপক্ষকে। অভিযানে মদ-গাঁজা পাওয়ার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় কারা কারা উপস্থিত ছিলেন বা সাক্ষী কে কে? অভিযান পরিচালনার জন্য তথ্য কিভাবে পেলেন এবং মধ্য রাতে অভিযান পরিচালনার কারণ কী, তাও জানতে চেয়েছে আদালত। একইসঙ্গে আরিফুল ইসলামকে দেয়া এক বছরের সাজার আদেশের কপি দাখিলেরও নির্দেশ দেয়া হয়। এদিকে আদালতের আদেশের পর ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন সাংবাদিকদের বলেন, দেশের কিছু কিছু জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোগল সম্রাটের মতো আচরণ করছেন। সরকারের কাছ থেকে বেতন নিয়ে তারা সরকারকে বিপদে ফেলার জন্যই ষড়যন্ত্র করছেন। এ সময় তিনি নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত থাকার ঘটনায় জামালপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং বর্তমানে সাংবাদিককে মধ্য রাতে সাজা দেয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রামের ডিসির কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রধানমন্ত্রী দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু আমলা দেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রধানমন্ত্রীর সেই কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করছেন। দেশের কিছু কিছু ডিসির আচরণ দেখে মনে হয়ে তারা মোগল সম্রাটের মতো আচরণ করছেন। এর আগে রবিবার বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন উর রশীদের পক্ষে আইনজীবী ইশরাত হাসান জনস্বার্থে রিটটি দায়ের করেন। রিটে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ১৭ জনকে বিবাদী করা হয়। এছাড়া ওই সাংবাদিককে সাজা দেয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনকে হাইকোর্টে তলবের নির্দেশনা চাওয়া হয় রিটে। রিটে ফৌজদারি কার্যবিধি, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন এবং সংবিধানের ৩১, ৩২, ৩৫ এবং ৩৬ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার মধ্য রাতে বাড়িতে হানা দিয়ে মারধর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে। তার বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড় শ’ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ আনা হয়। এরপর গভীর রাতে জেলা প্রশাসকের অফিসে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছরের কারাদ- দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। রবিবার দুপুরে কারাগার থেকে মুক্তি পান সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম। রিগানের সঙ্গে বর্বরতা কুড়িগ্রাম থেকে স্টাফ রিপোর্টার রাজুমোস্তাফিজ জানান, আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আকুতি-মিনতি করি। আল্লাহর কসম দেই। সন্তানের কসম দেই। প্রাণ ভিক্ষা চাই তাদের কাছে। এরপরও তারা ক্ষান্ত হচ্ছিলেন না। তারা আমাকে বারবার কলেমা পড়তে বলছিলেন। এ সময় আরডিসি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে।’ অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে এনকাউন্টার করা হবে বলে জানানো হলে এমন আকুতির কথা জানিয়েছিলেন সাংবাদিক আরিফুল। পরে তাকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতনসহ তার ভিডিও ধারণ করা হয়। জামিন পাওয়ার পর পরেই আরিফুলকে গুরুত্বর আহত অবস্থায় কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এ সময় উপরোক্ত কথাগুলো সাংবাদিকদের বলে কেঁদে ফেলেন আরিফুল ইসলাম। এ সময় এক আবেগ ঘন পরিবেশ তৈরি হয়। ইমার্জেন্সি বিভাগে ভর্তি করা হয়। তার এই জামিন নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন স্বজনরা। আরিফুল ইসলাম আরও জানান, চোখ বাঁধা অবস্থায় তার কাছ থেকে জোর করে চারটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়া হয়। পরে তাড়াহুড়া করে আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আমাকে যে নির্যাতন করা হয়েছে তার আঘাতের চিহ্ন আমার শরীরে আছে। জামিনের আবেদন করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আমি হাসপাতালে আসার পূর্ব পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তা আমার অসম্মতিতে হয়েছে। আমাকে ফোর্স করে করানো হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বেডে থাকা অবস্থায় সাংবাদিকদের এসব কথা জানান আরিফুল ইসলাম রিগান। বর্তমানে তিনি চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার রেদওয়ান ফেরদৌস সজিব জানান, আরিফুল ইসলাম রিগান বর্তমানে ভাল আছে। তার শারীরিক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এসব রিপোর্ট হাতে আসলে প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে। এদিকে রবিবার সকালে রিগানের জামিন নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। কিভাবে তার জামিন হলো এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান পরিবারের সদস্যরা। জামিনের কথা শুনে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে পূর্ব নির্ধারিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচী ফেলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ছুটে যান সাংবাদিকরা। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন সকাল সাড়ে ১০টায় সাংবাদিক আরিফুলের জামিন হয়েছে। এ ব্যাপারে আরিফুলের পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী এ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, আরিফুলের সম্মতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তিনি জামিনের জন্য আবেদন করেন। তার জামিন আপীল অনুমোদনের পর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুজাউদ্দৌলার আদালতে জামিন আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট এসএম আব্রাহাম লিংকন এবং আরিফুলের পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট শাখাওয়াত হোসেন ও এ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু। আপীল শুনানি শেষে ২৫ হাজার টাকার বন্ডে স্থানীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি এ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলুর জিম্মায় আরিফুলকে জামিন দেয়া হয় বলে জানা যায়। এর আগে শুক্রবার মধ্য রাতে ফিল্মি কায়দায় আরিফুলকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বেধড়কভাবে পেটাতে পেটাতে ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে জেলা প্রশাসক অফিসে তাকে নেয়া হয়। সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছর বিনাশ্রম কারাদ- এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের জেল দেয়া হয়। উল্লেখ্য, সকাল সাড়ে ১০টায় জামিন শুনানির পর দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগান। জামিনের বিরোধিতা করে রিগানের বোন রিমা জানান, আমরা কোন কাগজে স্বাক্ষর করিনি, আপীলও করিনি। আমরা সম্পূর্ণ বিষয়টি তার অফিসের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। অফিসের লোকজনের পরামর্শে আমাদের আপীল করার কথা ছিল। একই কথা জানালেন রিগানের মামা নবিদুল। তিনি জানান, আমরা ডিসি অফিসে এসেছি নথিপত্র তোলার জন্য। কিন্তু এসে জানতে পারলাম তাকে জামিন দেয়া হয়েছে। কে বা কারা করেছে আমাদের জানা নেই। পরিবারের পক্ষ থেকে জামিন চাওয়া হয়নি। এদিকে বাংলা ট্রিবিউনের ঢাকা ন্যাশনাল ডেক্স ইনচার্জ শাহ আলম সাংবাদিকদের জানান, যতটুকু জেনেছি তাকে আরডিসি অফিসে উলঙ্গ করে টরচার করা হয়েছে। যদি জামিন নেয়া হয়ে থাকে আমরা সম্পূর্ণ রূপে এর বিরোধিতা করছি। অর্থাৎ এটা আমরা অফিসিয়ালি ব্যবস্থা নিব কি করা যায়। চলমান এ ঘটনায় জনপ্রশাসন বিভাগের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন কুড়িগ্রামে কর্মরত সাংবাদিকদের ধৈর্য ধারণের অনুরোধ জানিয়ে দুপুর ২টায় মোবাইলে জানান, তদন্ত্র প্রতিবেদন পেলে সেটি পর্যালোচনা করে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকার কোন অন্যায়ের পক্ষে থাকবে না। এদিকে সাংবাদিক আরিফুলের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে কুড়িগ্রাম শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদের খবর পাওয়া গেছে। লালমনিরহাট থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রামে সংবাদকর্মী আরিফুল ইসলাম রিগানকে নিঃশর্ত মুক্তি ও জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের অপসারণের দাবিতে লালমনিরহাটে গণমাধ্যম কর্মীরা রবিবার সকাল ১০টা হতে শহরের প্রাণকেন্দ্র মিশন মোড়ে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন ও গণসমাবেশ করেছে। কর্মসূচীর আয়োজন করেছে লালমনিরহাটের কর্মরত সর্বস্তরের সংবাদকর্মী। কুড়িগ্রামের আটক সাংবাদিক মুক্তি ও ডিসিকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তে সাংবাদিকরা উল্লাস প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে শহরে মাইকিং করেন। এ সময় সাংবাদিকরা সড়কের ওপর বসে ক্যামেরা, ল্যাপটপ ও বুম রেখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। মানববন্ধন থেকে সাংবাদিক নেতারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের অপসারণ ও অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
×