ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

কাল ঢাকায় টিকফা বৈঠক শুরু

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ৪ মার্চ ২০২০

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র

এম শাহজাহান ॥ বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। টিকফা বৈঠক সামনে রেখে দেশটি তাদের এই আগ্রহের কথা সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকার ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে টিকফা ফোরামের পঞ্চম বৈঠক শুরু হবে। ওই বৈঠকে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল এখন বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। প্রতিনিধিদলের প্রধান দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টিটিভ মি. ক্রিস্টোফার উইলসন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন। ওই সাক্ষাতের সময় তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এদেশে তাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। আর এ কারণে বাণিজ্য সহজীকরণ নীতি প্রত্যাশা করছে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা। জানা গেছে, টিকফা বৈঠকের আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে মার্কিন বিনিয়োগ চাওয়া হবে। এই বিনিয়োগ চাওয়া হবে তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল অর্থনীতির উন্নয়নে। এছাড়া সমুদ্র আহরণ বা ব্লু ইকোনমিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ চাওয়া হবে। কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পেও দেশটির বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পরও যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাজার সুবিধা বহাল রাখে সে বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল দিতে চায় সরকার। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মোঃ জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, টিকফা বৈঠকের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে মার্কিন বিনিয়োগ। বিশেষ করে আইটি, ডিজিটাল অর্থনীতি, সমুদ্র সম্পদ আহরণ, বিদ্যুত, জ্বালানি ও সেবাখাতে দেশটির বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মার্কিন প্রতিনিধিদলটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রও এদেশের তাদের বাজার বড় করতে চায়। আর এ কারণে দেশটির পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে তুলা রফতানি সহজীকরণের ওপর। জানা গেছে, এবারের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বিনিয়োগ পরিবেশ, ব্যবসা সহজীকরণ, মার্কেট এক্সেস, ট্যারিফ পুনঃনির্ধারণ মেধাস্বত্ব, ডিজিটাল ইকোনমি, আঞ্চলিক যোগাযোগ, জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়ন, সরকারী ক্রয়ে স্বচ্ছতা এবং শ্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ সভায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশাধিকার সম্প্রসারিত করার বিষয়ে অনুরোধ জানানো হবে। বিশেষ করে নার্স, মিডওয়াইফসহ অন্যান্য সেবা খাতে মোড-৪ এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ সহজীকরণে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশে বিরাজমান বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্যাদি তুলে ধরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন চুক্তি বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য অনুরোধ করা হবে। বাংলাদেশী পণ্য বিশেষ করে গার্মেন্টস পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ওপর জোর দিবে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তি (টিকফা) কার্যকর করতে এবারের বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দল। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক মোঃ কামাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, টিকফার মূল উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো। বাংলাদেশের বিভিন্নখাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে চীন, জাপান, ভারত ও রাশিয়া যেমন দেশের বিভিন্ন অবকাঠামোখাতে বিনিয়োগ করছে ঠিক তেমনই যুক্তরাষ্ট্রেরও সেই সুযোগ রয়েছে। সমুদ্র সম্পদ আহরণে যুক্তরাষ্ট্রের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। জানা গেছে, একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি হয় বাংলাদেশ থেকে। বাণিজ্য ঘাটতি বরাবরই বাংলাদেশের অনুকূলে। তবে জিএসপি সুবিধা বাতিল, পোশাকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না করা, তৈরি পোশাক রফতানিতে উচ্চহারে শুল্ক আরোপসহ নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাধার মুখে পড়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত ট্রেড এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট (টিকফা)’র পঞ্চম সভা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও পাঁচ বছর আগে করা এ ফোরামের অগ্রগতি নিয়ে হতাশাও রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। কারণ এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোন বিনিয়োগ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ বাংলাদেশ ঘিরে। এত কম পয়সায় পৃথিবীর আর কোন দেশ পোশাক দিতে পারছে না। শুধু তাই নয়, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণেও বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। টিকফা বৈঠকে এবার এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ানোর আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ॥ টিকফা চুক্তি কার্যকরে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হবে। এছাড়া প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ রফতানি বাণিজ্য এগিয়ে নিতে চায় বাংলাদেশ। উদ্যোক্তারা বলছেন, পোশাক রফতানিতে জিএসপি সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশ কখনও লাভবান হতে পারেনি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য হচ্ছেÑতৈরি পোশাক। চীন-জাপানের পর অর্থনীতির পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে চান। এক্ষেত্রে বিদ্যুত ও জ্বালানি, গ্যাস উত্তোলন, জাহাজ নির্মাণ, রিসাইক্লিং, রাসায়নিক সার, অটোমোবাইল, হালকা প্রকৌশল, কৃষি-প্রক্রিয়াকরণ, ওষুধশিল্প, সিরামিক, প্লাস্টিক, পাটজাত পণ্য, তথ্য-প্রযুক্তি, সমুদ্রসম্পদ আহরণ, পর্যটন, চিকিৎসা উপকরণ ও টেলিযোগাযোগ খাত নিয়ে মার্কিন উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ মাত্র সাড়ে চার শ’ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার যা সক্ষমতার তুলনায় তা অনেক কম। যদিও ইতোমধ্যে বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুত খাত ছাড়াও আরও বেশকিছু খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে সহজ কর অবকাশ সুবিধা, কম শুল্কে যন্ত্রপাতি আমদানি, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য শতভাগ সমান সুবিধা, বাধাহীন এক্সিট পলিসি, মুনাফা নিজ দেশে নেয়াসহ নানা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৮ কোটি তরুণ জনশক্তি এবং ১৬ কোটি ক্রেতার বিশাল বাজার বিনিয়োগকারীদের সহায়ক হবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তির (টিকফা) ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেছেন। তুলা পরীক্ষার শর্ত শিথিল চায় যুক্তরাষ্ট্র ॥ এবারের টিকফা ফোরামের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে প্রথমেই আছে মার্কেট এ্যাকসেস বা বাজার প্রবেশসংক্রান্ত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে তুলা রফতানির সুবিধার্থে দেশটি এখানে আমদানিকৃত তুলা পরীক্ষার শর্ত শিথিলের প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে আমদানিকৃত মার্কিন তুলায় জীবাণু সংক্রমণের বিষয়ে দুই ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র এ পরীক্ষার ধাপ কম দেখতে চায়। এছাড়া বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরোপিত কর্পোরেট করহারও অনেক বেশি বলে মনে করছে দেশটি। এ কর কমানোর বিষয়েও আলোচনা করতে চায় তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বীমা পদ্ধতি চালুর সুযোগ দেখতে চায়। এ নিয়েও কথা বলতে আগ্রহী মার্কিন প্রতিনিধিরা। এছাড়া ই-ওয়েস্ট, ড্রাগস এ্যান্ড কসমেটিকস এ্যাক্ট, মেধাস্বত্ব, সরকারী ক্রয় ও শ্রমচর্চার বিষয়েও আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
×