ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জীববৈচিত্র্যের বিস্ময়কর সমারোহ সেন্টমার্টিন

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 জীববৈচিত্র্যের বিস্ময়কর  সমারোহ সেন্টমার্টিন

দেশের সর্ব দক্ষিণ শেষ সীমানা নারিকেল জিঞ্জিরা তথা সেন্টমার্টিন। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ বলেও খ্যাত এই সেন্টমার্টিন। যার অসাধারণ সৌন্দর্যের মায়াজালে আটকে পড়ে প্রতিবছর এই দ্বীপে ভ্রমণে আসে দেশী-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটক। স্বচ্ছ নীল জলরাশি, কেয়াবন, পাথুরে সৈকত, প্রবাল, শৈবালসহ বিস্ময়কর সব জীব-বৈচিত্রের সমারোহ। সেন্টমার্টিন নামটি শুনলেই চোখে ভেসে উঠবে ভ্রমণের বহু স্মৃতিকথা। তবে এখন হতাশা বিরাজ করছে সেন্টমার্টিনবাসীর মনে। কারণ বর্তমানে দ্বীপটির পরিবেশগত ঝুঁকি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, সৈকতে নাইলন ও প্লাস্টিকজাত চিপস প্যাকেট, আচারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, চায়ের কাপ, বোতল, পানির বোতল, পানির গ্লাস, প্লেট, ডাবের পানি খাওয়ার স্ট্র, খাবার প্যাকেট, ভাঙা চশমা বা কাঠি, মাছ ধরার জালের টুকরো, নাইলন দড়ির টুকরোসহ বিভিন্ন অপচনশীল বর্জ্যই দূষিত করছে দ্বীপটিকে। যার ফলে পরিবেশগতভাবে চরম হুমকিতে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থাই দ্বীপটির জন্য বড় দুঃসংবাদ বয়ে আনবে বলেও মনে করেন তারা। সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্যের মায়াজালে প্রতিদিন ঘুরতে যান দেশী-বিদেশী হাজারো পর্যটক। প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ-তে ৯টি পয়েন্টের নিষিদ্ধ কার্যক্রম রোধকল্পে) কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা, দ্বীপে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা, পর্যটক ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা, পর্যটকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করা, ছেঁড়াদ্বীপে পর্যটক নিষিদ্ধ করা, দ্বীপে স্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, দ্বীপে নিরাপদ খাবার পানির উৎস নিশ্চিত করা, পরিবেশ ছাড়পত্র ব্যতীত হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ বন্ধ করা, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র্য ও দ্বীপ রক্ষায় নীতিমালা তৈরি করাসহ নানান প্রস্তাবনা দিচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও টেকনাফ সৈকত এলাকাসহ দেশের ৬টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হওয়া সত্ত্বেও পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত, দ্বীপের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা না রেখে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ, দ্বীপের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত কেয়াবন উজাড়, পাথর উত্তোলন করে নির্মাণ কাজে ব্যবহারসহ পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকা-ের কারণে গত দেড় যুগে দ্বীপের ভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে। সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, মাটির পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বন্যপ্রাণী শিকার, শামুক, ঝিনুক, প্রবাল, শৈবাল, পাথর আহরণ ও সরবরাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও মানা হচ্ছে না কোনটিই। ইতোমধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপে আইন লঙ্ঘন করে তৈরি হয়েছে শতাধিক হোটেল-মোটেল। কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতর ও মৎস্য অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এই দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭-১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী ও ১২০ প্রজাতির পাখি। দ্বীপটির স্বচ্ছ পানিতে নামলে পাথরের স্তূপের ওপর নানা প্রজাতির প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুক ও অসংখ্য প্রজাতির মাছ দেখা যায়। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে সেন্টমার্টিন জায়গাটি প্রসিদ্ধ। ভাটার সময় দ্বীপের চারদিকে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল। পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, প্রতিটি দ্বীপের ভার বহনের নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতা থাকে। বর্তমানে এ দ্বীপের জনসংখ্যাই রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। এছাড়া পর্যটন মৌসুমে এই দ্বীপে প্রতিদিন আগমন ঘটে প্রায় ৮-১০ হাজার পর্যটক। যা ভার বহনের ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তিনি আরও বলেন, প্রভাবশালীরা দ্বীপের পরিবেশ ধ্বংস করে অবৈধভাবে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করছে প্রতিনিয়ত। ইতোমধ্যে দ্বীপে শতাধিক পাকা স্থাপনা নির্মাণ হয়ে হয়ে গেছে। কিছু কিছু হোটেল-মোটেলে পর্যটকরা যাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমুদ্র দেখতে পারে, এ জন্য দ্বীপের রক্ষা কবচ খ্যাত কেয়াবন কেটে ফেলা হচ্ছে অহরহ। যা দ্বীপটিকে বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা। কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বলেন, সেন্টমার্টিন কেবল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর একটি দ্বীপ নয়, এটি দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রও। তাই দ্বীপটি রক্ষায় সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, দ্বীপের ভার বহনের ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সর্বোচ্চ কতটি হোটেল-মোটেল, কটেজ বা পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে, কোথায় কোথায় স্থাপনা নির্মাণ করলে দ্বীপটির ইকোলজির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, প্রতিদিন কী পরিমাণ পর্যটক দ্বীপে আসতে পারবে, কিভাবে পর্যটন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, দ্বীপটির জীববৈচিত্র কিভাবে রক্ষা করা যাবে, এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা কেমন হতে হবে তা এ নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। অবিলম্বে সুস্পষ্ট নীতিমালা তৈরি করে দ্বীপ রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে এবং পর্যটকদের আনাগোনা নিয়ন্ত্রণে না আনা হলে সেন্টমার্টিন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে মনে করেন তিনি। উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময় সেন্টমার্টিন দ্বীপে বেড়াতে আসা পর্যটকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো নানান বিষয়ে সচেতনতা করে আসছে। কিন্তু নীতিগত কোন সিদ্ধান্ত না থাকায় চরম হুমকিতে পড়ছে দ্বীপটি। এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে
×