ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড় চূড়ায় মেধস মুনির আশ্রম

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

পাহাড় চূড়ায় মেধস মুনির আশ্রম

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা সন্ন্যাসী পাহাড় চূড়ায় রয়েছে প্রাচীন মেধস মুনির আশ্রম। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতার পাহাড় চূড়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘেরা এ আশ্র্রমে নানা উপাচারে নিত্য পূজিত হন দেবী দুর্গা। প্রতিদিন দুর্গম এ পাহাড়ী অঞ্চলে সমাগম ঘটে পুর্ণ্যার্থী, পূজার্থী, দশর্নাথী ও ভক্তের। পুরাকালে এ আশ্রমে ঋষি মেধস দেবী ভগবতীর আগমন ঘটিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কালের আবর্তে এই পীঠস্থান অবলুপ্ত হয়ে পড়ে। এই আশ্রমের কথা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রায় ১১৯ বছর আগে বেদানন্দ স্বামীজি যোগবলে আবিষ্কৃত করেন এ আশ্রম। পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রমের প্রবেশ পথে রয়েছে গণেশ মন্দির। ১৪০টি সিঁড়ি বেয়ে প্রায় আড়াই শত ফুট উপরে রয়েছে মেধস মুনির মন্দির। ওই পথের আরও কয়েক ধাপ এগুলে দৃষ্টিনন্দন মূল আশ্রম। মূল আশ্রমেই রয়েছে চ-ী মন্দির। চ-ী মন্দিরের পাশে রয়েছে আশ্রমের আবিষ্কারক যোগী পুরুষ স্বামী বেদানন্দ মহারাজের সমাধি মন্দির। মূল আশ্রমের ডানে পাহাড়ি পথে কিছু দূর এগুলে চোখে পড়বে কামাক্ষ্যা মন্দির। তারপরের সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় শিব মন্দির। এরপর ওই পাহাড়ের আরও কয়েকধাপ নেমে আবারও ওঠতে হয় আরেকটি পাহাড়ের শীর্ষে। ওই পাহাড়ের শীর্ষে রয়েছে তারা কালি মন্দির। মূল আশ্রমে বামে পাশের একটি পাহাড়ে রয়েছে মেধসশ্বরী দক্ষিণা কালি মন্দির। মূল আশ্রম, কামাক্ষ্যা মন্দির, শিব মন্দির ও তারা কালি মন্দিরে পাহাড়ে সন্ধিস্থলে রয়েছে মানস সরোবর। পাহাড় নিসৃত ঝর্ণা ধারা এ সরোবরে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হচ্ছে। মূল আশ্রম থেকে প্রায় ৩০০ ফুট নিচে এ সরোবর। তার পাশে রয়েছে সীতা মন্দির। জনশ্রুতি আছে ত্রেতাযুগে সীতা এ সরোবরে স্নান করেছিলেন। মূল চ-ী মন্দিরের পেছনের অংশে রয়েছে ভোগঘর, আশ্রম অধ্যক্ষের কার্যালয়, যাত্রী নিবাস। এ ভোগঘরের সামনে কাঁঠাল গাছের গোড়ায় বিলুপ্ত প্রজাতির রয়েছে ১২টি কাছিম। এরা ঋষি কচ্ছপ নামে পরিচিত। ফুল বেলপাতা ও ফলের খোসা খেয়ে জীবনধারণ করে এ বিলুপ্ত প্রজাতির কাছিম। কথিত আছে মেধস ঋষির শাপে কোন এক ঋষি কাছিমে পরিণত হয়েছিলেন। আশ্রমের তত্ত্বাবধানে রয়েছে দুটি গাভী ও একটি হরিণ শাবক। মেধস আশ্রম নিয়ে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল জেলার গৈরলা অঞ্চলের পন্ডিত জগবন্ধু চক্রবর্তীর ঘরে ১২৬৬ বঙ্গাব্দের ২৫ অগ্রহায়ণ জন্ম নেন চন্দ্র শেখর। জন্মের দু’বছর পর মারা যান তাঁর পিতা। মায়ের অনুরোধে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন মাদারীপুরের রাম নারায়ণ পাঠকের কন্যা বিধূমুখীকে। ছয়মাস পর মারা যান স্ত্রী বিধূমুখী। এর কিছুদিন পর মারা যান মা। সংসারে আপন বলতে আর কেউ রইল না। একাকিত্ব জীবনে এসে চন্দ্র শেখর নানা বেদ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে হয়ে ওঠেন প-িত। তখন নাম হলো শীতল চন্দ্র। তিনি মাদারীপুরে প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃত কলেজসহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে যোগী পুরুষ স্বামী সত্যানন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের পর চন্দ্র শেখরের মনে চন্দ্রনাথ দর্শনের তীব্র আগ্রহ জন্মে। তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। সেখানে তিনি বৈরাগ্য ধর্ম গ্রহণ করেন। ততদিনে চন্দ্রশেখর হয়ে ওঠেন (সন্ন্যাস নাম) বেদানন্দ স্বামী। সেখানে যোগবলে বেদানন্দ দর্শন লাভ করেন চন্দ্রনাথের (শিব)। চন্দ্রনাথ সেই দর্শনে বেদানন্দকে পাহাড়ের অগ্নিকোণে দৃষ্টি নিবন্ধ করার আদেশ দিয়ে বলেন, ‘দেবীর আবির্ভাবস্থান মেধস আশ্রম পৌরাণিক শত সহস্র বছরের পবিত্র তীর্থভূমি। কালের আবর্তে সেই পীঠস্থান অবলুপ্ত হয়ে পড়েছে। তুমি স্বীয় সাধনাবলে দেবীতীর্থ পুনঃআবিষ্কার করে তার উন্নয়নে মনোনিবেশ কর। দেবী দশভূজা দুর্গা তোমার ইচ্ছা পূরণ করবেন। দৈববলে প্রভূ চন্দ্রনাথের আদেশে বেদানন্দ স্বামী পাহাড়-পর্বত পরিভ্রমণ করে পবিত্র এ তীর্থভূমি মেধাশ্রম আবিষ্কার করেন। সপ্তসতী ‘চন্ডী’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ‘মেধা ঋষির’ আশ্রমের কথা উল্লেখ রয়েছে। পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ ও স্বজন পরিত্যক্ত বণিক সমাধি বৈশ্য উপস্থিত হয়েছিলেন মেধস মুনির আশ্রমে। মেধাশ্রমে মুনিপদে তাঁদের দুঃখের কথা ব্যক্ত করলেন। মেধা ঋষি সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের জাগতিক দুঃখ-দুর্গতির কথা শুনে মুনি তাঁদের শোনালেন, ‘মধুময়ী চন্ডী’। মেধা ঋষির উপদেশ শুনে সুরথ ও সমাধি বৈশ্য অরণ্য অভ্যন্তরে ঋষি মেধসের আশ্রমে মৃন্ময়ী প্রতিমা গড়ে সর্বপ্রথম মর্ত্যলোকে দশভূজা দুর্গাদেবীর পূজা শুরু করেছিলেন। ১৯২০ সালে যুক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার কাসিমবাজারের মহারাজ স্বর্গীয় মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী পাকা মন্দির নির্মাণ করে এবং পিতলের নির্মিত দেবী দুর্গার প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পিতলের প্রতিমা লুণ্ঠিত হয়ে যায়। এ আশ্রমে পাক বাহিনী মর্টার সেল নিক্ষেপ করে। পরবর্তীতে পাথরের প্রতিমা স্থাপন করে দেবী দুর্গা পূজা করা হয়। প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নসম্পদ বোয়ালখালীতে অসংখ্য প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রতœসম্পদ রয়েছে। শ্রীপুর বুড়ো মসজিদ, দেওয়ান ভিটা, করলডেঙ্গা হযরত বু-আলী কালন্দর শাহ (রাহঃ) মাজার, বেঙ্গুরা আহলা দরবার শরীফ, পোপাদিয়া কালাচাঁন ঠাকুর বাড়ি, কধুরখীল লালার দীঘি, কানুনগোপাড়া শ্যামরায় মন্দির ও পাহাড়চূড়ায় মেধস মুনির আশ্রম। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন এসব প্রাচীন নিদর্শনগুলো দেখতে প্রায় প্রতিদিন ভিড় করে। বিশেষ করে শুক্রবার ও শনিবার নারী ও পুরুষের ভিড় রয়েছে। বিশেষ করে কালাচাঁন ঠাকুরবাড়ি, মেধস মুনির আশ্রম, হযরত বু আলী কালান্দর শাহ্ মাজারে ভক্তবৃন্দের উপস্থিতি লক্ষণীয়। অর্থনীতি উপজেলার পাহাড়ে পাহাডের ঢালুতে বেসরকারী পর্যায়ে রয়েছে বিভিন্ন বাগান। এখানে উৎপাদিত সবজি জেলার গ-ি পেরিয়ে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি আরও কিছু কিছু পাহাড়ে বনায়ন শুরু করা হযেছে। শুরু হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে শাক সবজির কিছু কিছু বাগানও। এতে চাষ হচ্ছে লেবু, পেয়ারা, তরমুজ, ঝিঙ্গা, করলা ফলনও হচ্ছে। বর্তমানে এখানকার উৎপাদিত সবজি জেলার অন্যান্য লোকের চাহিদা মেটাচ্ছে। মেধস আশ্রম পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সচ্চিদানন্দ রায় চৌধুরী বলেন, প্রায় ৭০ একর পাহাড়ী জায়গা নিয়ে এই আশ্রম। পৌরাণিক এ তীর্থস্থান ভক্তদের আর্থিক অনুদানে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে পানি, বিদ্যুত সুবিধাসহ নান্দনিক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। সরকারীভারে এ আশ্রমকে সহায়তা করা হলে বিদেশী পর্যটকসহ ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম তীর্থস্থানে পরিণত হতো। মেধস আশ্রমকে জাতীয় আশ্রম ও তীর্থ ঘোষণার দাবি জানানো হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন হয়নি বললে চলে। তবে বৃক্ষ রোপণে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৮ সালে ২০১১ সালে ও ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে এ আশ্রম। আশ্রম পরিচালনায় ১০-১২ জন লোকের প্রয়োজন। সেই জায়গায় আশ্রমের সামান্য আয়ে কোন রকমে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। আশ্রমের অধ্যক্ষ বুলবুলনন্দ ব্রহ্মচারী জানিয়েছেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার উৎপত্তি এ মেধস আশ্রম। সড়ক যোগাযোগের করুন অবস্থার জন্য এ মেধস আশ্রমে আসা পূর্ণার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আশ্রমের সেবায়েত মিঠু দেব ও রণজিত দেব বলেন, প্রতিদিন আশ্রমে প্রায় ২শ’ লোকের সমাগম হয়। সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে তা হাজারে পৌঁছে। বিশেষ উপলক্ষে ২০-২৫ হাজার লোকে মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয় এ আশ্রম। বেশিরভাগ লোকজন এ আশ্রমে প্রসাদ নেন। যেভাবে যাবেন চট্টগ্রাম শহর থেকে বহদ্দারহাট-বাসটার্মিনাল এসে জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়ায় টেম্পোযোগে যেতে পারেন কানুনগোপাড়া অথবা দাশের দীঘিরপার। সেখান থেকে আবার সিএনজি করে জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায় যেতে পারেন করলডেঙ্গা পাহাড়ের মেধস মুনির আশ্রমে। -বিকাশ চৌধুরী, পটিয়া ও মুহাম্মদ মহিউদ্দিন, বোয়ালখালী থেকে
×