ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সকলকে ভোটার হতেই হবে এমন কথা নেই ॥ সন্তু লারমা

প্রকাশিত: ১০:১৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৯

 সকলকে ভোটার হতেই হবে এমন কথা নেই ॥  সন্তু লারমা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেছেন, জুম্ম জনগণ ২২ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করেছে। অথচ চুক্তির বাস্তবায়ন দেখেনি। পাহাড়ী জনগণ সব ক্ষেত্রে দুর্বলতর ও পশ্চাৎপদ। কিন্তু অধিকার ও মুক্তিকামী। তারা অবহেলা ও উপেক্ষার পাত্র হতে পারে না। ক্রান্তিকালীন পরিস্থিতিতে জুম্ম জনগণ জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। পিঠ তাদের দেয়ালে ঠেকে গেছে। সামনে এগোনোর করণীয় সম্পর্কে তারা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২২ বছরপূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে রবিবার সকালে ঢাকার হোটেল সুন্দরবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ জানিয়ে জনসংহতি সমিতির সভাপতি এমন বক্তব্য তুলে ধরেন। জনসংহতি সমিতির উ উইন মং জলির সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঐক্যন্যাপ সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ঢাবি শিক্ষক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, ও ড. রোবায়েত ফেরদৌস ও আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা ও ভোটার না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সন্তু লারমা বলেন, সবাইকেই জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে হবে, তবে ভোটার হতেই হবে এমন কথা নেই। দেশী আইনে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। বিষয়টি একান্তই ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। স্বাধীনতাযুদ্ধে পাহাড়ীদের অংশগ্রহণ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সারাদেশের মানুষের মতো পাহাড়ীরাও বাংলাদেশের স্বাধীনতা কামনা করেছিলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। তবে সারাদেশেই যেমন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অস্তিত্ব ছিল, পার্বত্যাঞ্চলেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। পাহাড়ীদের কিছু অংশ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অংশ হতেই পারে। একটি চক্রের কারণে পাহাড়ীরা অবাধে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি। এজন্য গণহারে বলা যাবে না, পাহাড়ীরা স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেননি। পাহাড়ীদের বহুধাবিভক্তি ও নিজেদের মধ্যে হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে সন্তু লারমা বলেন, সব পাহাড়ীকে একই দল ও মতাদর্শে বিশ্বাসী হতে হবে এমনটা আশা করা ঠিক নয়। বাংলাদেশে একই জাতির সদস্যরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে থাকেন। পাহাড়ীদের মধ্যেও এটি বিদ্যমান। শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়ার জন্য সরকার কিছুসংখ্যক বিপথগামী পাহাড়ীদের ব্যবহার করে, বিভিন্ন দল ও সংগঠন বানিয়েছে বলে অভিযোগ করেন সন্তু লারমা। সন্তু লারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলের প্রধান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলাম। শান্তিপূর্ণ ও শোষণ-নিপীড়নমুক্ত একটা নিরাপদ জীবন পাওয়ার আশায় চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পাহাড়ীরা তাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২২ বছর পেরোলেও সরকার চুক্তির মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যে সরকারের আমলে স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এক নাগাড়ে ১১ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর কোন পদক্ষেপ ও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিসহ জুম্ম জাতিসমূহের অস্তিত্ব চিরতরে বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র এখনও অব্যাহত আছে। নিরাপত্তাহীন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। চুক্তি মোতাবেক বহিরাগত সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন না করে, পার্বত্য চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ অবাস্তবায়িত রেখে সরকার উল্টো বাহাত্তরের মধ্যে ৪৮ ধারা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে অব্যাহত অসত্য প্রচার করছে অভিযোগ করেন সন্তু লারমা। তিনি বলেন, দীর্ঘ ২২ বছর অপেক্ষা করেও পাহাড়ীদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করে দেয়া হলো না। সেটি আজও সুদূরপরাহত। এটি পাহাড়ীরা কখনও ভুলতে পারে না। অগণিত মানুষের তাজা রক্ত আর অপরিসীম ত্যাগ-তিতীক্ষা, অকল্পনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন, দমন-পীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিনিময়ে অর্জিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জনগণ বৃথা যেতে দিতে পারে না। পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের নীতি পরিহার করে পার্বত্য চুক্তিকে পদদলিত করে, বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, পাহাড়ীদের জমি বেদখল করে, জুম্ম জনগণকে স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, সামরিক উপায়ে দমন পীড়নের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব পথ রুদ্ধ করে, জনসংহতি সমিতির সদস্যদের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত ও ফেরার করে, নেতৃস্থানীয়দের বন্দী ও জীবনহানি করে, জুম্ম জনগণকে নানা মিথ্যা অভিযোগে জিম্মি করে জনসংহতি সমিতির সদস্যদের সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে, পার্বত্য সমস্যা সমাধানের নামে যে কোন ধরনের চক্রান্ত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কখনই শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না। ঢাবি ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, বাংলাদেশে বাঙালী ছাড়াও আরো ৭৮ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আছে। তারা চায় তাদের মৌলিক অধিকার, সমঅধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে। তিনি বলেন, পার্বত্য সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। সুতরাং এর রাজনৈতিক সমাধানের জন্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছিল। সরকারের কাছে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, দীর্ঘ ২২ বছরেও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে ঠিক কত বছর পর বাস্তবায়ন হবে? ঐক্যন্যাপ সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে এই রাষ্ট্র উদার রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না। যে চুক্তি ২২ বছর আগে করা হয়েছিল সে চুক্তি এত বছরেও বাস্তবায়ন করতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়। শান্তি চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।
×