ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনুশোচনা নেই, জঙ্গীর মাথায় আইএসের টুপি

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

  অনুশোচনা নেই, জঙ্গীর মাথায় আইএসের টুপি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানোর ঘটনা মামলার রায় ঘোষণার পর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সাত জঙ্গীর কারও মধ্যে কোন অনুশোচনা দেখা যায়নি। রায়ের পর আদালত এলাকায় আসামি জঙ্গী রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিগ্যান মাথায় আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের (ইসলামিক স্টেট) পতাকার প্রতীক সংবলিত টুপি পরে ছিল। এরপর আসামিদের প্রিজন ভ্যানে তোলার পর আরও এক জঙ্গীকেও কালো কাপড়ে তৈরি একই রকম টুপি পরতে দেখা যায়। ওই জঙ্গীর নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী। বুধবার বিশ্বজুড়ে আলোচিত এ মামলার রায়ের পর পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামিদের কাছে কী করে ওই টুপি গেল, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি কেউ। কেবল আইএস টুপি নয়, রায়ের আগে, পরে এবং রায়ের সময় আদালতকক্ষেও আসামিদের আচরণ ছিল উদ্ধত। আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামিরা ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর’ বলে ওঠে। এরপর আসামিরা আদালতে উপস্থিত আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলে, আমাদের বিজয় খুব শীঘ্রই। এদিকে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সাত আসামির মধ্যে দুজনের মাথায় আইএসের প্রতীক সংবলিত কালো টুপির বিষয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার সকালে আদালতে আনার সময় কারও মাথায় এমন টুপি ছিল না। বের হওয়ার সময় রাকিবুলের মাথায় এই টুপি দেখা যায়। কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আনা এসব জঙ্গীরা আইএসের প্রতীক সংবলিত টুপি কোথায় পেল তা নিয়ে উপস্থিত সবার মধ্যে বিস্ময় ও প্রশ্ন তৈরি হয়। এরা কারাগার থেকে এ টুপি নিয়ে এসেছে নাকি আদালতে আনার সময় বা আনার পর কোনভাবে তাদের কাছে এই টুপি এসেছে। তা নিয়েও আদালত চত্বরে আলোচনা চলছিল। এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, এটি আমরা দেখেছি, ছবিও দেখেছি। আমরা বিস্মিত হয়েছি। কারাগার থেকে আনার সময় আসামিদের তল্লাশি করে দেখা হয়, তাদের সঙ্গে কি আছে তা দেখা হয়। এ ধরনের টুপি তাদের কাছে কীভাবে গেল, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হবে। এই নিয়ে দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, বিষয়টি জেনেছি, এটি নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। আমি এখনই তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানান, সকালে আদালতে আনার সময় রিগ্যানের মাথায় এই টুপি ছিল না। রায় ঘোষণা শেষে সে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মাথায় আইএসের একটি টুপি পরে। এরপরই উপস্থিত আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীদের নজরে আসে বিষয়টি। টুপি কোথায় থেকে পেল এমন প্রশ্নের জবাবে রিগ্যান বলে, কারাগার থেকে নিয়ে এসেছি। এরপরেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে কাঠগড়া থেকে নামিয়ে প্রিজনভ্যানে উঠিয়ে কারাগারে নিয়ে যায়। আসামি রিগ্যানের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন বলেন, আসামি চার বছর কারাগারে আছে। এ টুপি সে কোথায় পেল, এটা তো আমার প্রশ্ন। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এ ব্যাপারে পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার জাফর হোসেন বলেন, আমরা বিষয়টি নানা মাধ্যমে জানতে পেরেছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। রায় ঘোষণা শেষে অন্য আসামিদের সঙ্গে রিগ্যানও আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করে। আসামি রাজীব গান্ধী বলে, হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে তারা কোন অন্যায় করেনি। তারা এজন্য বেহেশতে যাবে। এই দেশে একদিন খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে বলে চিৎকার করে বলতে থাকে সে। রিগ্যানের আইএসের টুপি পরে আদালতে আসার প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবু আবদুল্লাহ জানান, আমি বিস্মিত হয়েছি। এই দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। তারা দায়িত্ব এড়াতে পারে না। এ নিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। তিনি জানান, রায় ঘোষণার সময় আসামিরা খুবই উদ্ধত আচরণ করেছে। কাঠগড়ায় তোলার পরও আসামিরা বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছিল। নারায়ে তাকবীর স্লোগান দিয়ে বলছিল, বিচার হবে হাশরের ময়দানে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, কারাগার থেকে আসামিদের স্যান্ডেল পরিয়ে আদালতে নিয়ে এলেও কাঠগড়ায় খালি পায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতেই তাদের খালি পায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সূত্রগুলো জানায়, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নব্য জেএমবির এসব জঙ্গীদের আদালত থেকে কারাগারে নেয়ার সময় তারা প্রিজনভ্যানের ভেতর থেকে চিৎকার করে নিজেদের কর্মকাণ্ডের পক্ষে বলতে থাকে। একই সঙ্গে স্লোগান দিতে থাকে। আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কীভাবে ওই টুপি তারা পেল- সে বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এসেছে। পুলিশের উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) জাফর আহমেদ এটা আমরা খেয়াল করতে পারিনি। ধর্মীয় টুপি বলেই মনে করেছিলাম। পরে বিষয়টি নজরে আসে। তবে আদালত থেকে এধরনের টুপি আসামিদের হাতে যাওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জ জেলার মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে জানান, কারাগার থেকে আসামিদের কেউ টুপি পরে যায়নি। আমাদের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখা হয়েছে। তাতে এই ধরনের আলামত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারাগার এই ধরনের ঘটনার সংশ্লিষ্টতা নেই। এদিকে রায় ঘোষণার পর আসামিরা যখন কারাগারে এসেছে, তখনও তাদের কাছে কোন কালো টুপি পাওয়া যায়নি। রায়ের পর প্রিজনভ্যানে ওঠানোর পর আসামিরা চিৎকার করে বলতে থাকে- খেলাফত শাসন প্রতিষ্ঠা হবেই। ‘আমরা আল্লাহর সৈনিক’, ‘আল্লাহর সৈনিকদের মৃত্যু হতে পারে না’, ২-৪ জনকে ফাঁসি দিয়ে জিহাদ দমন করা যাবে না। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে পিপি গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, আমি মন্তব্য করব না। তবে এর আগে আসামিরা যখনই আদালতে এসেছে এমন কোন অভিযোগ পাইনি। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের হাতে ছিল। আসামিরা কে কী পরে এসেছে সেটা নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক নয়। এটা পুলিশের বিষয়। সিটিটিসি যা বললেন কারও গাফিলতির কারণে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা মামলার ঘটনায় মৃত্যুদন্ড পাওয়া আসামিদের কাছে আইএসের লোগো সংবলিত টুপি এসেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। বুধবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। মনিরুল ইসলাম জানান, আইএসের কোন টুপি নাই আমাদের জানামতে। আইএসের সৃষ্টি থেকে এ পর্যন্ত কোন টুপি তারা তৈরি করেনি। তারপরও তাদের কোন টুপি আছে কিনা তা বিশ্লেষণ করে দেখব। পাশাপাশি কারও গাফলতির কারণে এরকম টুপি এজলাসে এসেছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে। তিনি জানান, এ রায়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা একটা মেসেজ পেল। ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কেউ সাহস পাবে না। কারা কর্তৃপক্ষের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সাত আসামির মধ্যে দুজনের মাথায় আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের (ইসলামিক স্টেট) প্রতীক সংবলিত কালো টুপির বিষয়ে তদন্ত করবে কারা কর্তৃপক্ষ। এজন্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি, প্রিজনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা। বুধবার বিকেলে কারা মহাপরিদর্শক জানান, আসামিদের মাথায় আইএসের টুপির বিষয়টি গণমাধ্যমে দেখেছি। এ বিষয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তিনি জানান, বাংলাদেশের সব কারাগারে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
×