ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আরও উন্নত বায়োনিক পা আসছে

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

আরও উন্নত বায়োনিক পা আসছে

পা কেটে বাদ দেয়া মানুষদের এখন আর কোন কষ্ট নেই, ভাবনা নেই সমস্যা নেই। তাদের জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে বায়োনিক কৃত্রিম পা। এটা তাদের স্বাভাবিক পায়ের মতোই কাজ করবে। তাদের শরীরের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে। এই বায়োনিক পায়ের ব্যবহার এমন হবে যে এটা তাদের শরীরেরই একটা অংশ বলে অনুভূত হবে। কারণ এই কৃত্রিম পায়ের সেনসরি ফিডব্যাক কাটা পায়ের উপরের অংশের নার্ভগুলোতে পৌঁছে যাবে। সার্বিয়ার নাগরিক ডিজুরিকা রেসানোভিচ বেশ কয়েক বছর আগে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছিলেন। তাঁর হাঁটুর উপরের অংশ থেকে পা কেটে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু নিউরোপ্রসথেটিক লেগের নতুন অভিনব প্রযুক্তির কল্যাণে রেসানোভিচ যে বায়োনিক পা লাগিয়েছিলেন বেলগ্রেডে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে সেটি তার দেহে সাফল্যের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে। বায়োনিক পায়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে রেসানোভিচ বলেন, ‘এতগুলো বছর পর আমি আমার পা ও পায়ের পাতার অস্তিত্ব আবার অনুভব করতে পারছি। মনে হচ্ছে এ যেন আমার নিজেরই পা। ব্যাপারটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। হাঁটার সময় বিশেষ মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। সামনের দিকে তাকিয়ে আপনি অনায়াসে হেঁটে যেতে পড়ে যাওয়া পরিহারের জন্য কৃত্রিম পা ঠিক কোথায় আছে সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়বে না।’ বেলগ্রেডের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যৌথ সহযোগিতায় ইউরোপীয় কনসোর্টিয়ামের একদল বিজ্ঞানী এই নিউরোপ্রসথেটিক উদ্ভাবন করেন এবং তিনজন পা কাটা মানুষের দেহে এগুলো সাফল্যের সঙ্গে সংযোজন করেন। এর ফলাফল সায়েন্স ট্রান্সল্যাশেনাল মেডিসিন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। কনসোর্টিয়ামের সদস্য জুরিখের অধ্যাপক স্টানিসা রাসপোপোভিচ বলেন, ‘আমরা প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে বায়োনিক পা নিয়ন্ত্রণের জন্য কম মানসিক চেষ্টার প্রয়োজন হয় কারণ যার পা কেটে বাদ দেয়া হয়েছে সে এই বায়োনিক পা’কে তার নিজ শরীরেরই অন্তর্গত বলে মনে করে।’ তিনি বলেন, হাঁটুর ওপর থেকে পা কেটে বাদ দেয়া ব্যক্তিদের জন্য বিশ্বে এই প্রথম এমন কৃত্রিম পা বের করা হলো যা সেনসরি ফিডব্যাক সজ্জিত। আমরা দেখিয়েছি এই ফিডব্যাক কৃত্রিম অঙ্গ ধারণের মানসিক চাপ লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ। এই বায়োনিক পায়ের কার্যক্ষমতা উন্নত ব্যবহার সহজ। চোখ বেঁধে ও ইয়ারপ্লাগ লাগিয়েও রেসানোভিচ তার বায়োনিক পায়ের অনুভূতি টের পেয়েছেন। হাঁটুর উপরের অংশে অক্ষত স্নায়ুতন্ত্রে অপারেশনের সাহায্যে যুক্ত করা ইলেকট্রোডের মাধ্যমে বিনা তারে সংবেদন তথ্য স্নায়ুতন্ত্রে পৌঁছে দেয়া হয়। এই ইলেকট্রোডগুলো অক্ষত ট্রিবিয়াল নার্ভকে চতুর্দিকে জড়িয়ে না ধরে সেই নার্ভের ভেতর ভেদ করে যায়। এই কৌশলটা সিলভেসট্রো মিসেরাব নেতৃত্বে পরিচালিত বায়োনিক হাতের গবেষণার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই দক্ষ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। রেসানোভিচ বলেন, বুড়ো আঙ্গুল, গোড়ালি বা পায়ের যে কোন অংশে স্পর্শ লাগলেই আমি এখন বলে দিতে পারি। এমনকি গোড়ালি কতটা বেঁকেছে বা নমনীয় হয়েছে তাও বলে দিতে পারি। রেসানোভিচসহ তিনজন নতুন বায়োনিক পা প্রযুক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য তিন মাসব্যাপী ক্লিনিক্যাল সমীক্ষায় অংশ নেন। এই বায়োনিক প্রযুক্তি আক্ষরিক অর্থেই নিউরো প্রকৌশলকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং এই ধরনের অতিমাত্রায় শারীরিক অক্ষম অবস্থার সম্ভাবনাময় নতুন সমাধান যুগিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইউরোপ ও আমেরিকার ৪০ লাখেরও বেশি লোক এজাতীয় শারীরিক অক্ষম অবস্থার শিকার। কৃত্রিম পায়ের পদতল ও কৃত্রিম হাঁটু থেকে অনুপুঙ্খ অনুভূতি ও সংবেদনশীলতার বদৌলতে রেসানোভিচসহ ওই তিনজন রোগীর সবাই বাধাবিঘেœর মধ্য দিয়ে চলাচল করতে পেরেছেন এবং হাঁটার সময় তাদের সেই কৃত্রিম পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখার ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কিছু কিছু বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা লেগে তারা হোঁচট খেয়েছেন তথাপি পড়ে যাওয়া সামলে নিতে পেরেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো মস্তিষ্কের ইমেজিং ও মনোদৈহিক পরীক্ষা থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে বায়োনিক পা নিয়ে মস্তিষ্ক অতটা ভারাক্রান্ত নয়। তার ফলে নানা ধরনের কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করার মতো অধিকতর মানসিক সক্ষমতা তাদের থেকে যায়। বায়োনিক পায়ের আদিরূপ পরীক্ষামূলক পর্যায়ে হলেও সাফল্য আসায় অনেকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ উৎসাহিত হয়েছেন। ‘সেনসআর্স নিউরোপ্রসথেটিক্স’ নামক এক প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ফ্রান্সিসকো পেট্রিনি এই প্রযুক্তিকে বাজারে আনার উদ্যোগের পথনির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রসথেটিক ডিভাইসগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সেনসরি ফিডব্যাক তৈরি ও বিকশিত করছি। রোগীদের স্বাস্থ্য ও জীবনমানের উন্নয়ন সম্পর্কে ক্লিনিক্যাল দিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উপসংহার টানার জন্য আরও বলিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত যোগাতে অধিকতর সংখ্যক রোগীর ওপর তিন মাসেরও বেশি তথ্যানুসন্ধান চালাতে হবে। বায়োনিক পায়ের মূল ব্যাপারটা হলো শরীর ও মেশিনের সংযোগ। অর্থাৎ শরীর ও মেশিনকে এক করে ফেলাই হলো নিউরো প্রকৌশলের মৌলিক নীতি। ব্যক্তির নিজের সত্যিকারের পা থেকে স্নায়ুতন্ত্র স্বাভাবিক অবস্থায় যেসব বৈদ্যুতিক সঙ্কেত লাভ করত নিউরো প্রকৌশল সেই সঙ্কেতগুলোই অনুকরণ করে। বিশেষ করে বায়োনিক পায়ের নমুনা রূপটিতে রয়েছে পায়ের পদতলজুড়ে ৭টি সেন্সর এবং হাঁটুতে একটি অনকোডার যা হাঁটুর ভাঁজের কৌণিক অবস্থান নির্ণয় করে। এই সেন্সরগুলো কৃত্রিম পায়ের স্পর্শ ও নড়াচড়া সম্পর্কিত তথ্য সৃষ্টি করে। পরে এই আনকোড়া সঙ্কেতগুলোকে একটা স্মার্ট এলগোরিদমের মাধ্যমে বায়োসিগন্যালে প্রকৌশলজাত করা হয়। এই বায়োসিগন্যালগুলো পায়ের যে অংশটা কেটে বাদ দেয়া হয়েছে তার উপরের অংশের স্নায়ুতন্ত্রে পাঠিয়ে ইন্ট্রানিউরাল ইলেকট্রোগুলোর মাধ্যমে টিবিয়াল নার্ভে প্রবেশ করানো হয়। আর এই সঙ্কেতগুলোই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ইন্টানিউরাল ইলেকট্রোড বিপুল সংখ্যক নিউরোপ্রসথেটিক্সের বাস্তব প্রয়োগের জন্য স্নায়ুতন্ত্রে বায়োসিগন্যালের তথ্যাবলী পৌঁছানোর মূল সূত্র। বাজারে নিউরোপ্রসথেটিক্স পাওয়ার সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতে খুব বেশি দেরি হবে না। এই তো হাতের কাছে এলো বলে। সূত্র : লাইফ সায়েন্স
×