ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কণিকা ॥ সুস্থ সংস্কৃতি কর্মী

প্রকাশিত: ১২:৫৫, ১৮ অক্টোবর ২০১৯

কণিকা ॥ সুস্থ সংস্কৃতি কর্মী

বর্তমান সময়ের নারী শিক্ষা দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধির একটি অনন্য পর্যায়। রক্ষণশীল সমাজের হরেক রকম প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে মেয়েরা যে মাত্রায় গতানুগতিক সংস্কারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে তা দেশের জন্য শুভ সঙ্কেত। সম্ভাবনাময় একটি দেশের সামনে চলার গতি যেমন দৃশ্যমান পাশাপাশি বিপর্যয় কিংবা সঙ্কটও কম দেখা যায় না। গণ মাধ্যমে এখনও খবর উঠে আসে বাল্য বিয়ের মতো সামাজিক অভিশাপ কিভাবে অবোধ বালিকাদের আলোকিত জীবনে বাধা তৈরি করছে। বাল্য বিয়ে মানেই কোন কন্যা সন্তান তার শিক্ষা নামক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার থেকে প্রায়ই বঞ্চিত। শুধু তাই নয় ছোট কালের বিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। যা কোন বালিকাবধূর বয়োসন্ধিকালটুকুও বুঝতে দেয় না। স্বাস্থ্য আর মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে সম্ভাবনাময় জীবনের ঘানি টানা। তেমন দৃশ্য বর্তমানে কমেও যাচ্ছে সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের এমন অসহনীয় অবস্থা সময় আর যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে এখন বাল্য বিয়ে ঠেকানোর মতো সংবাদও আমাদের আশ্বস্ত করছে। অনেক জায়গায় চমক দেয়ার মতো ঘটনায় একটি বালিকা নিজেকেই সমস্ত বন্ধন জাল থেকে মুক্ত করে জোর কদমে সামনে চলার পথকে অবাধ করতে পিছপা হচ্ছে না। প্রতিটি মানুষ যদি নিজে সচেতন দায়বদ্ধতায় মুক্ত হওয়ার পথ চলাকে অবারিত করতে না পারে বিপদ এবং আশঙ্কা সেখানেই। কণিকা গোপ ও গ্রামবাংলার গতানুগতিক সমাজ থেকে উঠে আসা এক উদ্দীপ্ত নারী যে কিনা পারিবারিক নির্মল আবহে শৈশব- কৈশোর অতিক্রান্ত করে আরও উচ্চতর পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অনুপ্রেবেশে নিজেকে তৈরি করতে থাকে। তার আগে ছোট্ট পারিবারিক আঙিনায় সুস্থ মানবিক আর মনন চর্চায় নিজের জীবনটাকে কিভাবে গোছালেন তাও এক বিশিষ্ট পর্যায়। পিতা কমলকান্তি গোপ আর মা শিলা গোপের দুই সন্তানের মধ্যে কণিকাই বড়। ছোট ভাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ বর্ষের বিবিএর ছাত্র। বাবা বাংলাদেশ রোফার স্কাউটের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এখনও পেশাগত জীবনকে মানব কল্যাণ ও প্রশিক্ষণে নিয়োজিত রেখে স্কাউটদের প্রতি তার সর্ববিধ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মা গৃহিণী হয়ে সন্তানদের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা না রাখলেও মাতৃ¯েœহে সার্বক্ষণিক নজরদারি থেকে কখনও সরে যাননি। মায়ের মায়া মমতায় নিজের ইচ্ছা পূরণের সব ধরনের সুযোগ তৈরি হওয়া চলার পথের এক অনন্য সংযোগ। ময়মনসিংহের জামালপুরে বাবা-মার ¯েœহছায়ায় বড় হওয়া কণিকা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বাবার কর্মজীবনকে আনন্দের সঙ্গে লালন ধারণ করত। সব সময় মনে হতো স্কাউটদের প্রতি বাবার যে দায়বদ্ধতা, মনোসংযোগ সেটাও নিজেকে মানুষ নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে। অতি সাধারণ মানুষের প্রতি ভালবাসা সে কারণে একেবারে বাল্যকাল থেকে। তেমন অনমনীয় বোধে সাংস্কৃতিক শুদ্ধ চেতনা মনবিকাশের অন্যতম পাথেয়। ন্যায়-অন্যায় বোধ তৈরি হয় পারিবারিক শুদ্ধ প্রতিবেশেই শুধু নয় তার চেয়েও বেশি সুস্থ মনন চর্চাকে মানবিক বোধে তাড়িত করা মেন সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরী। একজন নিষ্ঠাবান সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে সমাজের সমস্ত আবর্জনা সুস্থ মানসচেতনায় ধারাবাহিকভাবে অপসৃত করা ছাড়া সমাধান আসলে মুশকিল। কারণ দীর্ঘদিন ধরে সামজের গভীরে অবরুদ্ধ হরেক রকম অপসংস্কৃতি অসহায় মানুষের জীবনে যে সর্বনাশা দুর্যোগকে লালন করছে তাকেও ভেঙ্গে ফেলতে জোটবদ্ধ ঐক্য, সুস্থ মানবিক বোধ আর শুদ্ধ সংস্কৃতির নিয়তচর্চা ছাড়া বিকল্প অন্য কোন পথে হওয়া সম্ভব নয়। আলাপকালে এমন সব ভেতরের অন্তর্নিহিত চেতনাকে প্রকাশ করতে একেবারেই দ্বিধাহীন ছিল। নিজেকে যেভাবে তৈরি করেছে অসম সাহস আর অকৃত্রিম দেশত্মাবোধের প্রেরণা তাও এসেছে সাংস্কৃতিক পরিম-লের বিশুদ্ধ বলয় থেকে। কোন দেশের ভিত তৈরি হয় সে দেশের ভাষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সুষ্ঠু সমন্বয়ে। সেখানে সুদীর্ঘ সংগ্রাম আর লড়াইয়ের আবশ্যিক পর্যায়গুলোকে কোনভাবেই পাশ কাটানো যাবে না। জাতি গড়ার নিয়ামক স্থাপত্যগুলোকে নিজেদের মেধা ও মননে ধারণ করে একটি নিরাপদ, সুস্থির বাংলাদেশ তৈরির সম্ভাবনাকেও নিশ্চিত করতে হবে। সাবলীলভাবে সুস্থ সমাজ ব্যবস্থার দিকদর্শন যে ভাবে দিয়ে গেল তাকে কোনভাবেই হেলাফেলা করার মতো ব্যাপারই নয়। শিক্ষা জীবনটা শুরু হয় জামালপুর সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে। ২০০৬ সালে সেখান থেকেই কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক পর্ব সমাপ্ত করা। মানবিক বিভাগে ৪.০৬ গ্রেড পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তির ব্যাপার নিশ্চিত করতে চলে আসে মামার বাড়ি রংপুরে। তবে কথা শুনে বুঝতে অসুবিধা হয়নি নিজের মতো করে শিক্ষা জীবনকে এগিয়ে নেয়ার অনমনীয় প্রত্যয়। ফলে জিপিএ-৫ এর পেছনে সেভাবে ছুটতেও হয়নি তেমন পর্যায়ে বাবা মার অপ্রয়োজনীয় শাসন-খবরদারিও সামনে আসেনি। ফলে সুস্থ-স্বাভাবিক শিক্ষার্থীর জীবনটা গড্ডলিকা ¯্রােতে বয়েও যায়নি। পছন্দমাফিক, প্রয়োজনীয় জ্ঞানচর্চাই ছিল জীবন গড়ার দিকনির্দেশনা। রংপুরে গাইবান্ধা মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্ব সমাপ্ত করাও প্রবল ইচ্ছার এক বাস্তব রূপ। কারণ মা শিলা গোপ ও এই কলেজের ছাত্রী ছিলেন। সংসার-ধর্ম পালন করতে গিয়ে মায়ের অনেক অপূর্ণ স্বপ্ন ভেতরেই থেকে গেছে। কণিকা মায়ের এমন স্বপ্ন পূরণের সদিচ্ছাকে সম্মান জানাতে গাইবান্ধার মায়ের শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করার কলেজেই ভর্তি হয়। কোন এক সময় মন্দা, মঙ্গা ও অভাবী অঞ্চল হিসেবে পরিচিত গাইবান্ধার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে এক প্রশ্নে উত্তরে জানা যায় আগের তুলনায় অনেক সঙ্কট কাটলেও ভেতরের সমস্যা জিইয়ে থাকার ব্যাপারটি মাঝে মধ্যে স্পষ্ট হতেও সময় লাগে না। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দারিদ্র্য বিমোচনের ব্যাপারে রংপুরের স্থান বাংলাদেশের অন্য অঞ্চললের চাইতে অনেকটা নি¤œগামী বলে জানা যায়। গাইবান্ধা মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক করার পর সরাসরি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়াও শিক্ষা জীবনের এক আবশ্যকীয় পর্যায়। মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে ¯œাতক-¯œাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করার প্রয়োজনীয় সময়গুলোতে বিনোদনের মাত্রায় নিজস্ব সাংস্কৃতিক জগত তৈরি করা তাও এক ধরনের দেশ ও সমাজের প্রতি সচেতন দায়বদ্ধতা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সারির নেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে খুব বেশি সময় লাগেনি। স্বনন আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যিক কাব্য ভুবনে নিজেকে উজাড় করা চৈতন্যের এক সুষম শৈল্পিক শৈলী। এর পর ঢাকায় চলে আসা। নতুন কর্মজীবনের যাত্রা শুরু। বর্তমানে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিভাগে উপব্যবস্থাপক হিসেবে পেশাগত জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানেও সেই একই সাধারণ মানুষের প্রতি নিঃশর্ত দায়বদ্ধতায় প্রতিনিয়ত শাণিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য সেবার মতো মহৎ ও বৃহৎ কর্মযোগে কিছুটা পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করাই অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। জীবনটা এভাবে মানুষের জন্য উৎসর্গ করতে চায় কণিকার যাত্রাপথে সর্বাঙ্গীন মঙ্গল ও সফল হবে এমন আশা ব্যক্ত করাই যায়। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×