ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বজ্রপাত মোকাবেলায় প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতনতার তাগিদ

প্রকাশিত: ১০:১০, ৭ অক্টোবর ২০১৯

 বজ্রপাত মোকাবেলায় প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতনতার তাগিদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বজ্রপাতজনিত জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় জনসচেতনতাই প্রধান নিয়ামক শক্তি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে বজ্রপাতজনিত ভয়াবহতা ব্যাপকভাবে বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুহার বেড়েছে লক্ষ্যণীয়ভাবে। বজ্রপাতে প্রতি বছর ২শ’ থেকে তিন শ’ জনের মৃত্যু ঘটছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত যেভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বজ্রপাতজনিত ক্ষয়ক্ষতি রোধে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশকেও সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রবিবারও বজ্রপাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই পরিবারের চারজনসহ মোট সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। রবিবার রাজধানীর কাকরাইলে আইডিইবি ভবনে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি) আয়োজিত ‘বজ্রপাতজনিত ভয়াবহতা মোকাবেলায় করণীয়’ শীর্ষক গোল টেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সংগঠনের সভাপতি এ কে এম এ হামিদের সঞ্চালনায় গোলটেবিলে আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি ও দৈনিক জনকণ্ঠের সিটি এডিটর কাওসার রহমান, নিউজ ২৪ এর সাংবাদিক মোঃ মাহমুদুল হাসান, দৈনিক বর্তমানের চীফ রিপোর্টার মোতাহার হোসেন, ইউএনবির মাসউদুল হক, বিজনেস নিউজের চীফ রিপোর্টার মোঃ মাজহারুল আনোয়ার খান, দৈনিক যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক সুচি সৈয়দ, চ্যানেল আইর সিনিয়র নিউজ এডিটর আদিত্য শাহীন, জিটিভির চীফ রিপোর্টার রাজু আহমেদ, বিটিভির প্রযোজক মাসুদ এ হাসান, যমুনা গ্রুপের জিএম মোঃ মিজানুর রহমান, আজাদীর ঢাকা ব্যুরো প্রধান এম ওয়াহিদ উল্লাহ, আমাদের সময়ের স্টাফ রিপোর্টার চপল মাহমুদ, এসএ টিভির স্টাফ রিপোর্টার মিজান আহমেদ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইডিইবির সাধারণ সম্পাদক মোঃ শামসুর রহমান। বিষয়ের ওপর পৃথক ২ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইডিইবির রিসার্চ ফেলো মোঃ ইয়াকুব হোসেন শিকদার ও মোঃ মনির হোসেন। আলোচকবৃন্দ বলেন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও বিকাশমান অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রেক্ষিতে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির বহুমাত্রিক ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে ক্রমেই বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশঙ্কাজনক হারে ঘটছে প্রাণহানি। প্রাণহানির পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, ২০১৫ সালে ২৭৪ জন, ১৬ সালে ৩৮৭ জন, ১৭ সালে ৩৭২ জন, ১৮ সালে ৪৪৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। এদের অধিকাংশই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। যাদের মধ্যে প্রান্তিক কৃষক ৩৪ ভাগ, নির্মাণ শ্রমিক ২৬ ভাগ, পথচারী ৯ ভাগ, সামরিক কাজে ৪ ভাগ, বার্জে ৪ ভাগ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ২৩ ভাগ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। বজ্রপাতের আগাম সঙ্কেত ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা গেলে উদ্বেগজনক প্রাণহানির হার কমিয়ে আনা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন সকালে আবহাওয়ার বার্তা পর্যবেক্ষণ করা, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকলে ঘন ঘন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পূর্বপ্রস্তুতি সম্পর্কে শ্রমিকদের অবহিত করার ব্যবস্থা করা দরকার। আর কর্মস্থলের নিকটবর্তী নিরাপদ স্থান চিহ্নিতকরণ করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা অপরিহার্য। অনুষ্ঠানে বিশেষ আলোচক হিসেবে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি কাওসার রহমান বলেন, ভারতের ওড়িশা রাজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারী কোম্পানির সহযোগিতায় এক নতুন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা জারি করে মৃতের সংখ্যা ৩১ শতাংশ কমানো গেছে। সতর্কবার্তা পাওয়ার পরই যে এলাকায় বাজ পড়তে পারে, সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মোবাইলে এসএমএস করে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে সাইরেন বাজিয়ে সাবধান করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে দৈনিক জনকণ্ঠের সিটি এডিটর কাওসার রহমান আরও বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েছে লক্ষ্যণীয়ভাবে। বজ্রপাত নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছে ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরাম তাদের হিসেবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে বজ্রপাতে ২৪৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে, আহত হয়েছেন ৯৭ জন। ২০১২ সালের পর থেকে প্রাণহানির সংখ্যা ২০০ এর নিচে নামছে না। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, বজ্রপাত কেড়ে নিচ্ছে গ্রামের কর্মঠ পুরুষদের। তিনি আরও বলেন, এতদিন পর্যন্ত এটা ছিল গ্রামীণ এলাকাতে। এখন এটা দেখা যাচ্ছে শহর এলাকাতেও। সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে দশ লাখ গাছ লাগাতে। এই গাছগুলো বড় হতে তো সময় লাগবে। তাই এই সময়ের মধ্যে টাওয়ার নির্মাণ করতে চায় সরকার। তবে সব কিছুর চেয়ে বেশি দরকার সচেতনতা। টেলিভিশন, রেডিওতে বিভিন্নভাবে সচেতন করার কাজ করছে সরকার। আর ১০৯০ নম্বরে ফোন করে যে কেউ কোথায় বৃষ্টি হবে কোথায় বিজলি চমকাবে সেটা জানতে পারবে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের খেটে খাওয়া অল্প শিক্ষিত মানুষদের পক্ষে ফোন করে বৃষ্টি বাদলের খবর নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া অনেক সময় সম্ভব হবে না। প্রতিবেশী দেশ ভারত যেভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বজ্রপাতজনিত ক্ষয়ক্ষতিরোধে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশকেও সেই প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে যেতে হবে। পাশাপাশি প্রত্যেক গ্রামে যেভাবে মোবাইল টাওয়ার বসানো হচ্ছে তার সঙ্গে আর্থিং সিস্টেম সংযুক্ত করতে পারলে বজ্রপাতে মৃত্যু রোধ করার কাজে সেটি একটি ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন জনকণ্ঠের সিটি এডিটর কাওসার রহমান। চাঁদপুর ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, চাঁদপুর শহরের পর্যটন কেন্দ্র বড় স্টেশন মোলহেডে কুমিল্লা থেকে বেড়াতে আসা একই পরিবারের ৪ জন নিহত হয়েছেন। রবিবার বেলা দেড়টার দিকে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- অহিদা বেগম (৬৫), তার মেয়ে রেহানা বেগম (৩৫), নাতি সাব্বির (১৪) ও নাতনি সামিয়া (১০)। অহিদা বেগম কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার কৈলান গ্রামের সুলতান আহমেদের স্ত্রী। মেয়ে রেহানা বেগম চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার ৬ নম্বর উজানি ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামের মোঃ শাহজাহানের স্ত্রী। নিহতের আরেক মেয়ে শাহিদা বেগম বলেন, তার মা ও বোনসহ ৪ জন দুপুরে ঘুরে আসেন বড় স্টেশন মোলহেডে। হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে বজ্রপাতে তারা সকলেই আহত হন। স্থানীয় লোকজন তাদেরকে উদ্ধার করে চাঁদপুর সরকারী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সকলকেই মৃত বলে ঘোষণা করেন। চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ঘটনাটি আমরা জেনেছি। পরবর্তী আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। নিহত ৪ জনের মরদেহ বর্তমানে চাঁদপুর সরকারী জেনারেল হাসপাতালে রয়েছে। অপরদিকে ঘটনার সংবাদ পেয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসক বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারও হাত নেই। নিহতদের পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। মাগুরা ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, রবিবার দুপুরে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার ঝামা বাজারে বজ্রপাতে বিপ্লব (২১) নামে এক নির্মাণ শ্রমিক এবং মোসলেম মোল্লা (৬২) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। তিনি একই উপজেলার ম-লগাতি গ্রামের মৃত খসরুজ্জামানের ছেলে। মহম্মদপুর উপজেলার ঝামা বাজারে একটি বাড়ির ছাদে বৃষ্টির মধ্যে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করার সময় বজ্রপাতে বিপ্লব গুরুতর আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা হাসাপাতালে নেয়া হলে জরুরী বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মহম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তারক বিশ্বাস ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, বজ্রপাতে একজন নিহত হয়েছেন। বাগেরহাট ॥ স্টাফ রিপোর্টার জানান, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে বজ্রপাতে বিমল মিস্ত্রি (৫৫) নামে এক দিন মজুরের মৃত্যু হয়েছে। রবিবার দুপুরে উপজেলার হোগলাপাশা গ্রামে একটি বাড়িতে গাছ কাটার সময় বজ্রপাতে তিনি মারা যান। নিহত বিমল মিস্ত্রি হোগলাপাশা গ্রামের মহেন্দ্র মিস্ত্রির ছেলে। হোগলাপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ রেজাউল ইসলাম নান্না বলেন, বিমল মিস্ত্রি তার বাড়ি থেকে কিছু দূরে গাছ কাটছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে বজ্রপাত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই বিমল মারা যান।
×