ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে...

প্রকাশিত: ১০:২৮, ৫ অক্টোবর ২০১৯

শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে...

মোরসালিন মিজান ॥ শরতে আজ কোন্ অতিথি/এল প্রাণের দ্বারে...। শরতের অতিথি হয়ে এসেছিলেন সন্জীদা খাতুন। অনেকদিন পর কোন অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা গেল। সাত সকালে চারুকলার বকুলতলায় সশরীরে উপস্থিত তিনি। বয়স হয়েছে। শরীর এখন কিছুটা নড়বড়ে। কিন্তু মনের যে জোর, সে তো চিরকালের। তা-ই সঙ্গী করে চলে এসেছিলেন। অহর্নিশ সংগ্রামীকে শরতের সকালের মতোস্নিগ্ধ আর সতেজ দেখাচ্ছিল। বাঙালিত্বের সাধনায় গোটা জীবন উৎসর্গ করা সন্জীদা খাতুন ছায়ানটের সভাপতি। তার প্রিয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শুক্রবার খোলা সবুজ চত্বরে আয়োজন করা হয়েছিল শরতের অনুষ্ঠান। বরাবরের পরিকল্পিত পরিপাটি আয়োজন। শুদ্ধ সুরে প্রকৃতি বন্দনা। একক ও সম্মেলক সঙ্গীতের পাশাপাশি ছিল নৃত্যায়োজন। শরতের বিদায় ক্ষণটাকে যেন রাঙিয়ে দিয়ে গেলেন শিল্পীরা। দর্শক হয়ে এক কোনে চুপটি করে বসে থাকা সন্জীদা খাতুন যেমন ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশনায় মুগ্ধ হলেন, তেমনি উপভোগ করলেন বাকিরা। এদিন পূর্ব নির্ধারিত সময় সকাল ৭টায় শুরু হয় শরতের অনুষ্ঠান। তারও আগে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করে দেখা যায়, অঙ্গনটিকে চমৎকার সাজিয়ে নেয়া হয়েছে। সাজিয়ে নেয়া বলতে, প্রাণহীন ডিজিটাল ব্যানার ইত্যাদি দিয়ে ছেয়ে ফেলা নয়। বরং প্রকৃতির স্বাভাবিক রং রূপটাকে নিজের করে নেয়ার সচেতন প্রয়াস। বিশাল বকুল গাছটিকে আঁকড়ে ধরে থাকা মঞ্চে যোগ হয়েছিল শুধু কাশফুল। আমার বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ...। সেই কাশের গুচ্ছ দূরের কোন নদীর ধার থেকে তুলে এনে মঞ্চে স্থাপন করা হয়েছিল। দর্শক সারিতেও কাশফুল। মৃদু হাওয়ায় ফুলেরা তুলোর মতো ওড়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছিল নগর জীবনের সকল ক্লান্তি। অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া মানুষও গায়ের পোশাকে শরতের রংটুকু ধারণ করেন। মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নীল রঙের শাড়ি পরে এসেছিলেন। খোঁপায়, না, শেফালিমালা দেখা গেল না। শিউলি বা শেফালি এখন বেশ দুর্লভ। অন্য ফুল খোঁপায় গেঁথে নিয়ে এসেছিলেন তরুণীরা। ছেলেদের সাজ বলতে সাদা পাঞ্জাবি। তাতেই আয়োজনটির সঙ্গে বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। বাবা মায়ের হাত ধরে এসেছিল বাচ্চারাও। গান শুনেছে তারা। গুন গুন করে গেয়েছে। মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছে। আর ছবি তোলা? সে তো বলাই বাহুল্য। এসব ছবির মাধ্যমে দূর দূরান্তে পৌঁছে গেছে শরত উৎসবের খবর। সম্মেলক নৃত্য-গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। মঞ্চে দুই সারিতে বসেছিলেন কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীরা। কেউ গাইছিলেন। বাজাচ্ছিলেন কেউ। মূল মঞ্চের একেবারে সামনের দিকে আবার আলাদা আয়োজন করে ক্ষুদে শিল্পীদের বসানো হয়েছিল। সবাই মিলে গাইছিল : ওগো শেফালি-বনের মনের কামনা।/কেন সুদূর গগনে গগনে/আছ মিলায়ে পবনে পবনে...। মধ্য মঞ্চে এ সময় চলছিল নৃত্যায়োজন। রবীন্দ্রনাথের এ গানের সঙ্গে চলা নৃত্য আশপাশটাকে কেমন যেন জাগিয়ে দিয়ে যায়। এর পরই একক কণ্ঠ। মঞ্চের বাম পাশে বসা অভয় দত্ত নতুন ভোরের বার্তা দিলেন। গাইলেন, ‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে।’ ডান পাশ থেকে শ্রাবণী মজুমদার যখন গাইলেন ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’, তখন আরও যেন উপভোগ্য হয়ে উঠলো সকালটা। শিল্পীর সঙ্গে কতজন যে গুন করে গাইছিলেন! একক পরিবেশনা শেষ হতেই সম্মেলক গান। ‘আলোর অমল কমল খানি কে ফুটালো’ গানের সঙ্গে চমৎকার নাচলেন একদল শিল্পী। সুতপা সাহা, মোস্তাফিজুর রহমান তূর্য, তানিয়া মান্নান, শ্রেয়া ঘোষ, শুক্লা পাল সেতু, আইরিন পারভীন অন্না, অসীম দত্ত, নাইমা ইসলাম নাজ, সেজুঁতি বড়ুয়া প্রমুখও একক কণ্ঠে শরত বন্দনা করেন। মুগ্ধ হয়ে তাদের গান শুনেন শ্রোতা। একক নৃত্য নিয়ে মঞ্চে ছিলেন তাথৈ। বরাবরের মতোই তার নাচ ছিল উপভোগ্য। নাচের মূদ্রা অঙ্গ সঞ্চালন এক্সপ্রেশসন সব মিলিয়ে সুন্দর একটি পরিবেশনা। এভাবে একক ও সম্মেলক নাচে গানে ধ্রুপদী চেহারা পায় অনুষ্ঠানটি। অন্যদের মতো দর্শক সারিতে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করেন সন্জীদা খাতুন। উৎসবের পূর্ণতা দিতেই যেন এসেছিলেন তিনি। পুরোটা সময় এক কোণে চুপটি করে গান শুনেছেন। নৃত্যায়োজন উপভোগ করেছেন। সত্যি বলতে, তার এই শোনা এবং দেখার দৃশ্যটাও আলাদা করে দেখার মতো ছিল। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে ছাত্রছাত্রীরা এসে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করছিলেন। কুশল বিনিময় করছিলেন। এরই মাঝে মূল আয়োজন শেষ হলে চলে আসে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পালা। প্রথমে মনে হয়েছিল, বার্ধক্যের ধর্ম মেনে হয়তো চেয়ারে বসেই জাতীয় সঙ্গীত গাইবেন সন্জীদা খাতুন। কিন্তু একদমই তা হলো না। লাঠিতে ভর দিয়ে ঠিক ওঠে দাঁড়ালেন তিনি। গাইলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ শরতের সকালে এমন প্রিয় পুজনীয়’র পাশে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার স্মৃতিটুকু আরও অনেকের মতো এই প্রতিবেদকেরও অনেকদিন মনে থাকবে। এদিকে সন্জীদা খাতুনের কথা বলা বারণ। এরপরও সময় সুযোগ বুঝে তার কাছে যেতেই মুখ খুললেন। ছোট্ট করেই বললেন, বহুদিন পর বের হলাম। চারপাশে এত ভিড়। ঝামেলা। ঝঞ্ঝাট। এখানে এসে কিছুটা সময় তো পেলাম, গানের কথায় স্বরে পাওয়া গেল। তিনি বলেন, সকালের অনুষ্ঠান শরতকে বড্ড প্রতিফলিত করে। সকালটাকে পাওয়ার জন্য এমন আয়োজন খুব জরুরী। শরতের শেষভাগে এসে অনুষ্ঠান আয়োজনের সুন্দর একটি ব্যাখ্যাও দিলেন তিনি। বললেন, আশ্বিনটাকেই বেশি করে শরত মনে হয় আমার কাছে। মূলত এ কারণেই দ্বিতীয় মাসে এসে শরতের অনুষ্ঠান করা। তো, সব মিলিয়ে কেমন লাগলো আপনার ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশনা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সকালের সুর, একটু টেনে টেনে গাইতে হয়। সব সময় জমে না। কোরাসগুলোই ভাল লাগল বেশি। একটু ব্রাইট হয়। এ ধরনের আয়োজনের প্রভাব এখন নগর জীবনে কতটা পড়ে? এ প্রশ্নও করা হয়েছিল তাঁকে। সন্জীদা খাতুনের উত্তর- আমরা তো কোন কিছুই সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি না। সম্ভব নয়। তবে যারা এ ধরনের অনুষ্ঠানে আসে তাদের উপর প্রভাব পড়ে। তারা ভাল কিছু অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। ছোট এবং সহজ কথায় কী সুন্দর বলা! এই সুন্দরের জয় হোক।
×