ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার

প্রকাশিত: ১০:২৩, ১৭ আগস্ট ২০১৯

 ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার

নিখিল মানখিন ॥ চলতি বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা পঞ্চাম হাজারে পৌঁছে গেছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও কর্তা ব্যক্তিরা আগামী সেপ্টেম্বরের শুরুতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন তা বাস্তবে রূপ দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের বিবেচনায় বিগত ১৮ বছরের একের পর এক রেকর্ড অনেক আগেই পেছনে পড়ে গেছে। এ বছর প্রথমবারের মতো দেশের সব কটি জেলায় রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সরকারী পরিসংখ্যানে মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ বলা হলেও বেসরকারী পরিসংখ্যানে এই সংখ্যা ৮৫ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর খবর বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে। ২৭ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর খবর স্বীকার করেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ডেঙ্গু পিক মৌসুমের প্রথম মাস আগস্টের ১৬ দিনেই ৩১ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের চিত্রটি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সামনে ডেঙ্গুর পিক মৌসুমের আরও আড়াই মাস পড়ে আছে। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে নানা কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পরও দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন ভয়াবহতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা বাস্তবে রূপ দিতে চলেছে। পিক মৌসুমের প্রথম মাসের ১৬ দিনেই তা ফুটে উঠেছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণসমূহ তুলে ধরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়ে থাকে। গত ১৮ বছরের সরকারী পরিসংখ্যানে এই তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। এ বছর জুলাইয়ে শনাক্ত হয়েছে অস্বাভাবিক ডেঙ্গু রোগী। ডেঙ্গুর পিক মৌসুম হিসেবে পরিচিতি আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস। গত ১৮ বছরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলতি বছরেও এই পিক মৌসুমে ডেঙ্গু রোগী আক্রান্তের পুনরাবৃত্তি ঘটলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে এবং তা নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠিন হয়ে পড়বে। আর আগস্ট মাসের ১৬ দিনেই ৩১ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের চিত্রটি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় এডিস মশা দ্বারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া, ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে যাওয়া, ডেঙ্গু পরীক্ষার উপকরণের সঙ্কট, কার্যকর এডিস মশক নিধন কার্যক্রমের অভাব এবং সারাদেশে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসার প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব ইত্যাদি কারণসমূহও ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন বছরে ডেঙ্গুর পিক মৌসুম হিসেবে পরিচিত আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৪৮ জন। আর ওই বছরের জুনে ২৯৫ জন, জুলাইতে ৯৪৬, আগস্টে ১৭৯৬ জন, সেপ্টেম্বরে ৩০৮৭ জন ও অক্টোবরে ২৪০৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। ২০১৭ ও ২০১৬ সালেও আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। এভাবে ২০১৫ সালের মার্চে ২ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ১ জন, জুনে ১৫ জন, জুল্ইায়ে ১৫৬ জন, আগস্টে ৭২৭ জন, সেপ্টেম্বরে ৯৬৫ জন, অক্টোবরে ৮৮০ জন, নবেম্বরে ২৬০ জন ও ডিসেম্বরে ৯০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। সূত্রটি আরও জানায়, রাজধানীতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৭ জন, মার্চে ৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ১২ জন, জুনে ৫০ জন, জুলাইয়ে ১৭২ জন, আগস্টে ৩৩৯ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৮৫ জন এবং অক্টোবরে আক্রান্ত হয় ৫০১ জন। আর ২০১৯ সালে জুনে ১৮৬৩ জন, জুলাইয়ে ১৫ হাজার ৬৪৮ জন ও আগস্টের ১৬ দিনে ৩১ হাজার ৫৩৮ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আর সামনে পড়ে আছে পুরো সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস। অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত সর্বমোট ডেঙ্গু আল্ডান্ত ভতি রোগীর সংখ্যা ৪৯৯৯৯ জন এবং ছাড়পত্র পাওয়া মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৪২২৪৩ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে সর্বমোট ডেঙ্গু আল্ডান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭৭১৬ জন। রাজধানীসহ সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি রোগী ভর্তি হয়েছে ১৭১৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা শহরে ৭৫০ এবং বিভিন্ন বিভাগে ৯৬০ জন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু সংখ্যা ৪০ জন। বর্তমানে ঢাকার ৪০টি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে ডেঙ্গু আল্ডান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৪০১৫ জন এবং ঢাকা শহর ব্যতীত অন্যান্য বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছে মোট ৩৭০১ জন। আর ১-১৬ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৩১৫৩৮ জন। সূত্রটি আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১১৮ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৭২ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২০ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৭৯ জন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ জন, রাজারবাগের পুলিশ হাসপাতালে ৯ জন, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮৭ জন, পিলখানার বিজিবি হাসপাতালে ৩ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ২২ জন এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৫১ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। আর ঢাকা শহর ছাড়া ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলায় ২২৯ জন, ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলায় ৬৪ জন, চট্টগ্রামের ১১টি জেলায় ১৬২ জন, খুলনা বিভাগের ১০টি জেলায় ১৫১ জন, রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলায় ১৩২ জন, রংপুর বিভাগের ৮টি জেলায় ৭২ জন, বরিশালের ৬টি জেলায় ১০৫ জন এবং সিলেট বিভাগের ৪টি জেলায় ১৫ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা শহর ছাড়া ঢাকা বিভাগে ৭৬২ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৮৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৭৭ জন, খুলনা বিভাগে ৬০৫ জন, রাজশাহী বিভাগে ৪২৮ জন, রংপুর বিভাগে ২৫৯ জন, বরিশাল বিভাগে ৫৪৬ জন এবং সিলেট বিভাগে ৪০ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। ১৯ বছরে রাজধানীতে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী ও মৃতের সংখ্যা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সালে ৫৫৫১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৯৩ জন, ২০০১ সালে ২৪৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৪৪ জন, ২০০২ সালে ৬২৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১০ জন, ২০০৪ সালে ৩৪৩৪ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৩ জন, ২০০৫ সালে আক্রান্ত ১০৪৮ জন ও মৃত্যু ৪ জন, ২০০৬ সালে আক্রান্ত ২২০০ জন ও মৃত্যু ঘটে ১১ জনের। এভাবে ২০০৭ সালে ৪৬৬ জন, ২০০৮ সালে ১১৫৩ জন, ২০০৯ সালে ৪৭৪ জন এবং ২০১০ সালে ৪০৯ আক্রান্ত হলেও ওই চারটি বছরে কেউ মারা যায়নি। আর ২০১১ সালে ১৩৫৯ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১২ সালে ৬৭১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১ জন, ২০১৩ সালে ১৭৫৯জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ২ জন, ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন আক্রান্ত , ২০১৫ সালে ৩১৬২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১৬ সালে ৬০৬০ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৪ জন , ২০১৭ সালে আক্রান্ত ২৭৬৯ ও মৃত্যু ৮ জন এবং ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্তের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যু ঘটে। ফরিদপুরে ৬১ জন হাসপাতালে ভর্তি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, ফরিদপুর থেকে জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ৬১ জন ফরিদপুরের বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩৪ জন, ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে ১০ জন, বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪ জন, আলফাডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২ জন, মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪ জন, ডায়াবেটিক হাসপাতালে ৫ জন ও আরোগ্য সদনে ২ জন। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন এনামুল হক জানান, গত ২০ জুলাই থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ফরিদপুরের বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মোট ভর্তি হয়েছে এক হাজার ২৫ জন। শুক্রবার পর্যন্ত চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩৬০ জন। চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন ৫৪৪ জন। রেফার্ড করা হয়েছে ১১৮ জনকে। এ পর্যন্ত মারা গেছে ৩ জন। প্রসঙ্গত ফরিদপুরের ১৩টি সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে এ পর্যন্ত যে এক হাজার ২৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন তার মধ্যে ফরিদপুরে নিজ বাড়িতে থেকে আক্রান্ত হয়েছে ১৮৮ জন।
×